শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে রাজা যযাতির এক চমৎকার কাহিনী উপস্থাপিত হয়েছে। তাঁর কাহিনী মহাভারতের আদিপর্ব এবং মৎস্য পুরাণেও বর্ণিত হয়েছে। রাজা যযাতির জীবন আমাদের সকলকে এক এমন যাত্রায় নিয়ে যায়, যেখানে একজন মহিমান্বিত বংশে জন্মগ্রহণকারী যুবক, সৌন্দর্য, বীরত্ব ও সাহসের প্রতীক, কামনা-বাসনা ও ভোগবিলাসের অসীম ফাঁদে পড়ে যান এবং শেষপর্যন্ত সেখান থেকে বিজয়ী হয়ে বেরিয়ে আসেন। রাজা যযাতি সেই ব্যক্তি, যিনি যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে সবকিছু হারিয়েছিলেন, পরে তা পুনরুদ্ধার করেন এবং অবশেষে সবকিছু ত্যাগ করে স্বর্গীয় ধামে প্রবেশ করেন।
या दुस्त्यजा दुर्मतिभिर्जीर्यतो या न जीर्यते ।
तां तृष्णां दुःखनिवहां शर्मकामो द्रुतं त्यजेत् ।।
যা দুস্ত্যাজা দুর্মতিভির্জীর্যতো যা ন জীর্যতে।
তাং তৃষ্ণাং দুঃখনিবহাং শর্মকামো দ্রুতং ত্যাজেৎ।
ইন্দ্রিয়ভোগের আকাঙ্ক্ষাই সমস্ত দুঃখের মূল। দুর্বল-মনের ব্যক্তিদের পক্ষে এই ইন্দ্রিয়সুখ ত্যাগ করা অত্যন্ত কঠিন। দেহ জীর্ণ হয়ে যায়, কিন্তু কামনা থাকে যৌবনের মতোই সতেজ। তাই যে নিজের কল্যাণ চায়, তার যত শীঘ্র সম্ভব জাগতিক কামনা-বাসনা ত্যাগ করা উচিত। (ভাগবতম ৯.১৯.১৬)
যযাতি ছিলেন বিখ্যাত রাজা নাহুষের দ্বিতীয় পুত্র। বড় ভাই যতি সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর যযাতি রাজ্যাভিষিক্ত হন। তিনি দৈত্য-গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দেবযানী দৈত্যরাজ ঋষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠাকে নিজের দাসী হিসেবে রাখেন। কীভাবে একজন রাজার কন্যা শর্মিষ্ঠা একজন ব্রাহ্মণের কন্যা দেবযানীর দাসী হয়ে উঠলেন — সেই কাহিনীও অত্যন্ত চমকপ্রদ।
ইতিহাস: শর্মিষ্ঠা ও দেবযানীর সাক্ষাৎ
শর্মিষ্ঠা ও দেবযানী একসময়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। একদিন তারা সহস্র সখীসঙ্গে জলে ক্রীড়া করছিলেন। ঠিক তখনই হটাৎ করে শিব ও পার্বতী হ্রদের পাড়ে আসতেই সবাই দ্রুত উঠে পোশাক পরিধান করে। কিন্তু ভুল করে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর পোশাক পরে ফেলে। দেবযানী এতে প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হন এবং শর্মিষ্ঠাকে কঠিন ভাষায় তিরস্কার করেন। রাজকুমারী শর্মিষ্ঠা এই অপমান সহ্য করতে না পেরে প্রতিশোধের জন্য দেবযানীকে এক কূপের মধ্যে ঠেলে ফেলে দেন। শর্মিষ্ঠা ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পর, কাকতালীয়ভাবে রাজা যযাতি সেখানে আসেন এবং দেবযানীকে উদ্ধার করেন। পরে দেবযানী বাড়ি ফিরে তার পিতা শুক্রাচার্যের কাছে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন। কন্যার অপমান শুনে শুক্রাচার্য অত্যন্ত রুষ্ট হন এবং রাজা ঋষপর্বার সভা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও ঋষপর্বা একজন দৈত্যরাজ, তবুও তিনি তার গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং তার ক্রোধকেও ভয় করতেন। তাই শুক্রাচার্যকে শান্ত করতে ঋষপর্বা ও শর্মিষ্ঠা দেবযানীর শর্ত মেনে নেন — শর্মিষ্ঠা আজীবন দেবযানীর দাসী হিসেবে তাঁর সেবা করবেন এবং যেখানেই দেবযানী যাবেন, তাঁকে অনুসরণ করবেন।
শর্মিষ্ঠার প্রস্তাব ও যযাতির প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ
বর্তমান কাহিনী তে ফিরে আসা যাক — দেবযানী ও রাজা যযাতির বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে, এবং শর্মিষ্ঠা তাদের সঙ্গে রাজসভায় যান। যদিও যযাতি একজন মহান রাজা, তবুও তিনি ইন্দ্রিয়ভোগের আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত নন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কামপ্রবণ এবং তাঁর দরবার ছিল রমণীতে পরিপূর্ণ। দেবযানীকে যযাতির সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার সময় শুক্রাচার্য রাজা যযাতির কাছ থেকে একটি প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন — তিনি কখনোই শর্মিষ্ঠাকে নিজের শয্যায় আহ্বান করবেন না। কিন্তু যযাতি এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারেননি। একদিন, শর্মিষ্ঠা দেখতে পান যে দেবযানী যযাতির পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তখন তাঁরও মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগে। এক সন্ধ্যায় তিনি যযাতির কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন, যেন তিনি তাকে একটি পুত্রসন্তানের জননী হতে সহায়তা করেন। রাজা যযাতি তাঁকে রাজার দেওয়া প্রতিজ্ঞার কথা শর্মিষ্ঠাকে মনে করিয়ে দেন।
তখন শর্মিষ্ঠা বলেন, “হে রাজন, হাস্যপরিহাসে, নারীর প্রতি কামভোগে, বিবাহের সময়, প্রাণসংকটে এবং সর্বস্ব হারানোর আশঙ্কায় — এই পাঁচ পরিস্থিতিতে মিথ্যা বলা পাপ নয়। এই অবস্থায় মিথ্যাচার ক্ষমাযোগ্য।” দুজনের মধ্যে দীর্ঘ তর্ক-বিতর্কের পর, ইন্দ্রিয়লোলুপ রাজা যযাতি অবশেষে শর্মিষ্ঠার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এর ফলে, শর্মিষ্ঠার গর্ভে যযাতির তিন পুত্র জন্ম নেন — দ্রুহ্যু, অনু ও পুরু। দেবযানীর গর্ভে জন্ম নেয় দুই পুত্র — যদু ও তুর্বসু।
শুক্রাচার্যের শাপ, যযাতির মুক্তির সংগ্রাম, এবং পুরুর মহান ত্যাগের গাথা
যযাতি ও শর্মিষ্ঠা কিছু সময়ের জন্য তাঁদের সম্পর্ক গোপন রাখতে সক্ষম হন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেবযানীর তা জানতে পেরে যান। তিনি প্রচণ্ড রেগে যান এবং সঙ্গে সঙ্গেই পিতার গৃহে চলে যান। রাজা যযাতির এই কুকর্ম জানার পর শুক্রাচার্য তাঁকে অভিশাপ দেন — তিনি অকালেই বার্ধক্য ও দুর্বলতার শিকার হবেন। একজন কামনাপ্রবণ পুরুষের জন্য যৌবন ও প্রাণশক্তি অকালে হারানো যেন সবচেয়ে বড় কষ্ট! যযাতি চরম যন্ত্রণায় পড়েন এবং তাঁর শ্বশুর শুক্রাচার্যের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন,“হে ভৃগুপুত্র, আমি এখনও যৌবনের সুখে বা দেবযানীর সান্নিধ্যে তৃপ্ত হইনি। অতএব, হে করুণাময়, আপনি দয়া করুন যাতে বার্ধক্য আমাকে স্পর্শ না করে।”
অবশেষে শুক্রাচার্য দয়া করে তাঁকে একটি বর দেন — তিনি নিজের বার্ধক্য ও দুর্বলতা তাঁর পুত্রদের মধ্যে যেকোনো একজনের সঙ্গে বিনিময় করতে পারবেন। শুক্রাচার্য আরও বলেন, যে পুত্র তার পিতাকে নিজের যৌবন দান করবে, সেই হবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। তার হবে দীর্ঘ জীবন, বিস্তৃত খ্যাতি এবং অগণিত সন্তান। বার্ধক্যে নতজানু যযাতি রাজ্যে ফিরে এসে তাঁর সকল পুত্রকে আহ্বান করেন, কিন্তু কেউই নিজেদের যৌবন পিতাকে দিতে রাজি হয় না। অবশেষে, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র পুরু সম্মতি দেন, এবং যযাতি আবার তাঁর যৌবন ফিরে পান।
পুরুর যৌবন লাভ করে যযাতি অত্যন্ত প্রীত ও তৃপ্ত হন। পুনরায় তিনি পরিপূর্ণভাবে নিজের প্রিয় ভোগ-বিলাসে লিপ্ত হন। তিনি যেন স্বর্গরাজ ইন্দ্রের মতো পুরো পৃথিবী শাসন করতে থাকেন। তাঁর ইন্দ্রিয়গুলো সম্পূর্ণ অক্ষত থাকে, এবং তিনি ধর্মের সীমা লঙ্ঘন না করেই অসীম ও অতুলনীয় ভৌতিক সুখ ভোগ করতে থাকেন। বিশ্বের বিরলতম বস্তুগুলোর উপভোগে তিনি পরম আনন্দ পান। তবে তাঁর একমাত্র আক্ষেপ এই — এই সকল সুখ-সুবিধা একদিন শেষ হয়ে যাবে।
যযাতির অকৃপণ বাসনা ও পরম ত্যাগের অধ্যায়
যযাতির মনে সবসময় একটি সত্য লুকিয়ে থাকে — সহস্র বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তাঁকে সবকিছু ত্যাগ করতেই হবে। হাজার বছর ধরে সব ধরনের ভোগ-বিলাসে মগ্ন থেকেও তিনি সম্পূর্ণ তৃপ্ত হতে পারেননি। একদিকে তাঁর কামনা আগুনের মতো দগ্ধ হতে থাকে, অন্যদিকে তিনি বুঝতে পারেন এই ভৌতিক সুখ ক্ষণস্থায়ী। অবশেষে, যখন তিনি দেখেন যে তাঁর সহস্র বছরের যৌবনের সময় শেষের দিকে, তখন তিনি পুত্র পুরুকে আহ্বান করে তাঁর যৌবন ফিরিয়ে দেন। এরপর রাজসিংহাসনে পুরুকে অধিষ্ঠিত করে রাজা বনে গমন করেন। তাঁর সঙ্গে যান ব্রাহ্মণ ও তপস্বীরা। অরণ্যে অবস্থানকালে তিনি বহু কঠোর ব্রত পালন করেন, ফলমূল খেয়ে জীবনযাপন করেন এবং তপস্বীদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি স্বর্গে আরোহণ করেন এবং কিছু সময় সেখানে সুখে বাস করেন। কিন্তু শীঘ্রই দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে স্বর্গ থেকে নিচে ফেলে দেন। কেন ইন্দ্র তাঁকে স্বর্গ থেকে ফেলে দিলেন এবং তারপর তাঁর কী হল — সেই গল্পের বাকি অংশ ভবিষ্যতে একদিন অন্য কোনো লেখায় প্রকাশ পাবে।
শিক্ষণীয় বিষয়
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে রাজা যযাতির আকস্মিক বৈরাগ্যপ্রাপ্তিকে তুলনা করা হয়েছে একটি পাখির সঙ্গে, যে ডানার পূর্ণ বিকাশ ঘটার সাথে সাথেই বাসা ছেড়ে উড়ে যায়। রাজা যযাতি এই কাহিনীর নৈতিকতা তাঁর প্রিয় পত্নী দেবযানীর কাছে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন:
न जातु कामः कामानामुपभोगेन शाम्यति ।
हविषा कृष्णवर्त्मेव भूय एवाभिवर्धते ।।
না জাতু কামহ কামানামুপভোগেনা শাম্যতি।
হবিষা কৃষ্ণবর্তমেব ভূয় এবাভিবর্ধতে ।।
অগ্নিতে ঘি ঢাললে যেমন আগুন নিভে না, বরং আরও বৃদ্ধি পায় — তেমনি কামনাকে ভোগের মাধ্যমে নিবারণ করার চেষ্টা কখনোই সফল হয় না। (মহাভারত, আদি পর্ব ১.৮৫.১২)
মানুষের সব সময় মনে রাখা উচিত যে জাগতিক সুখ — তা পৃথিবীতেই হোক বা স্বর্গলোকে — সবই ক্ষণস্থায়ী ও নিরর্থক। এই জ্ঞানকে মনে রেখে কারোরই উচিত নয় এমন ভোগের চিন্তা বা আকাঙ্ক্ষা করা। মানুষের মনে এই জ্ঞানটি চিরস্থায়ী রূপে থাকা উচিত যে, শুধুমাত্র ভোগের চিন্তাও মানুষকে জন্ম-মৃত্যুর অনন্ত চক্রে আবদ্ধ করে। যে এই সত্যটি উপলব্ধি করে, সেই প্রকৃত আত্মজ্ঞানী।