চলুন, ভারতের উৎসব ও ঐতিহ্যের বিস্ময়কর জগতে পা রাখি! দীপাবলি একটি পাঁচ দিনব্যাপী উৎসব, যা সারা দেশে মহা ধুমধাম ও জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। কিন্তু আপনি কী জানেন, দীপাবলির দ্বিতীয় দিন, যাকে নরক চতুর্দশী বলা হয়, সেটি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন নামে এবং বিশেষ রীতিতে উদযাপিত হয়?
শ্রীকৃষ্ণ ও সত্যভামার নরকাসুর বধ
এই উৎসবের উৎপত্তি এক পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে জড়িত। ভৌমাসুর নামে এক অসুর ছিল, যাকে নরকাসুর নামেও ডাকা হয়। সে বহু রাজ্য দখল করে নিয়েছিল। সে ভগবান ব্রহ্মার কাছ থেকে এমন এক বর পেয়েছিল যে, কেবল তার মা ভূমিদেবীর (পৃথিবী মাতার) হাতেই তার মৃত্যু সম্ভব। ভূমিদেবীও ভগবান বিষ্ণুর কাছ থেকে একটি বর লাভ করেছিলেন—তাঁর ইচ্ছা ছাড়া তাঁর পুত্রের মৃত্যু হবে না। এই দুই বর ও গর্বের জোরে নরকাসুর এক অত্যাচারী শাসকে পরিণত হয়েছিল। সে দেবতাদের প্রতি, বিশেষ করে নারীদের প্রতি কোনো সম্মান দেখাত না। সে ইন্দ্রকে পরাজিত করে ১৬,০০০ নারীকে অপহরণ করে নিজের প্রাসাদে বন্দি করে রেখেছিল। নরকাসুর দেবতা বরুণের ছাতা, দেবমাতা অদিতির কুন্ডল (কানবালা) এবং মেরু পর্বতে অবস্থিত দেবতাদের মণিপর্বতও চুরি করে নিয়েছিল।
ইন্দ্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হন এবং নরকাসুরের নৃশংস কার্যকলাপ সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেন। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় পত্নী সত্যভামাকে সঙ্গে নিয়ে গরুড়ে চড়ে রওনা দেন নরকাসুরের রাজধানী প্রাগজ্যোতিষপুরের উদ্দেশ্যে। সেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও নরকাসুরের মধ্যে এক ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের মাঝে শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে অচেতন হওয়ার ভান করেন, যাতে সত্যভামা উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সত্যভামা তখন দৃঢ়ভাবে যুদ্ধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তীক্ষ্ণ তীর দিয়ে নরকাসুরকে বধ করেন।
শ্রীকৃষ্ণ এই কৌশলটি গ্রহণ করেছিলেন কারণ কেবলমাত্র নরকাসুরের মা-ই তাঁকে হত্যা করতে পারতেন, এবং সত্যভামাকে সেই কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। সত্যভামা ছিলেন ভূমিদেবীর অবতার, এবং নরকাসুরকে বধ করা ছিল তাঁর পূর্বনির্ধারিত ধর্ম।
নরকাসুরকে পরাজিত করার পর, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবমাতা অদিতির চুরি হয়ে যাওয়া কুন্ডলগুলি পুনরুদ্ধার করেন। সত্যভামার স্বামী ভক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে অদিতি তাঁকে আশীর্বাদস্বরূপ চিরযৌবন ও অনন্ত সৌন্দর্যের বর প্রদান করেন।
শ্রীকৃষ্ণের নরকাসুর বধ কেবল এক দানবের পতনই নয়, বরং বহু বন্দিকে মুক্ত করার পথও খুলে দেয়—যাদের মধ্যে ছিলেন সেই ১৬,০০০ নারী, যারা দীর্ঘদিন ধরে বন্দি অবস্থায় ছিলেন। সমাজে তাঁদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের সকলকে সসম্মানে বিবাহ করেন, এবং এইভাবে তাঁদের সম্মান ও সামাজিক অবস্থান ফিরিয়ে দেন।
ভারতের নানা প্রান্তে নরক চতুর্দশী উদ্যাপন : আঞ্চলিক রীতি ও প্রথা
দেশের উত্তরভাগে এই দিনটি ‘ছোটি দীপাবলি’ নামে পরিচিত, আর দক্ষিণ ভারতে এটি পালিত হয় ‘তামিল দীপাবলি’ হিসেবে। মহারাষ্ট্রে ভক্তরা এই দিনে ‘অভ্যঙ্গ স্নান’ নামক এক বিশেষ স্নান অনুষ্ঠান পালন করেন।
আর সবচেয়ে মজার বিষয় কী আপনি তা জানেন? নরক চতুর্দশীর পেছনে রয়েছে এক চমকপ্রদ পৌরাণিক কাহিনি!
নরক চতুর্দশী সেই বিশেষ যেদিন নরকাসুর বধ হয়েছিল। এই দিনটি ‘কালী চৌদ্দশী’ নামেও পরিচিত, যখন মানুষ প্রদীপ জ্বালিয়ে ও বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে, যাতে জীবনের অলসতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
পশ্চিমবঙ্গে এই দিনটি ‘ভূত চতুর্দশী’ নামে পরিচিত। বিশ্বাস করা হয়, এই রাতের প্রাক্কালে মৃত ব্যক্তিদের আত্মারা তাঁদের প্রিয়জনদের কাছে আসেন। ধারণা অনুযায়ী, পরিবারের ১৪ জন পূর্বপুরুষ তাঁদের জীবিত আত্মীয়দের দর্শনে আসেন, তাই বাড়ির চারপাশে ১৪টি দীপ জ্বালানো হয়, যাতে তাঁরা পথ চিনে আসতে পারেন এবং অশুভ শক্তি দূরে থাকে।
ভারতের কিছু রাজ্যে এই দিনেই দীপাবলি উদ্যাপন করা হয়, যা এই উৎসবের তাৎপর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। নরক চতুর্দশী হল এক আধ্যাত্মিক মননচর্চার সময়, যেখানে মিলনের আবহে শুভ শক্তির বিজয়ে অশুভ পরাভূত হয়।