ঋষ্যশৃঙ্গের জন্ম, জীবন ও কার্যকলাপ এক অনন্য মহাকাব্যিক কাহিনি, যা ধর্ম, তপস্যা, প্রলোভন এবং ভাগ্যের চক্রকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছে।
অদ্ভুত জন্ম ও নারীবিহীন জীবন
ঋষি বিভাণ্ডক ছিলেন এক মহান তপস্বী, যিনি শৈশব থেকেই কঠোর তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র ভয় পেলেন যে বিভাণ্ডকের কঠোর সাধনা স্বর্গের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাই, ইন্দ্র অপ্সরা উর্বশীকে পাঠান বিভাণ্ডকের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য। উর্বশী সফলভাবে তাঁকে প্রলুব্ধ করেন একটি পুত্র জন্ম দেওয়ার জন্য। তবে বিভাণ্ডক নিজে সম্পর্ক স্থাপন না করে উর্বশীকে তাঁর বীর্য উপহার দেন এবং বলেন, “তুমি নিজেই গর্ভধারণ করো।”কিন্তু উর্বশীর আসল উদ্দেশ্য ছিল বিভাণ্ডকের তপস্যা ভঙ্গ করা, সন্তান জন্ম দেওয়া নয়। তাই তপস্যা ভঙ্গ হওয়ার পর, তিনি সেই বীর্য একটি হরিণীর গর্ভে স্থাপন করেন। কিছুদিন পর, সেই হরিণী এক মানবশিশুর জন্ম দেয়, যার মাথায় হরিণের শিং ছিল। এইভাবেই জন্ম নেন ঋষ্যশৃঙ্গ— “হরিণশৃঙ্গ বিশিষ্ট শিশু।”
উর্বশীর ঘটনার পর ঋষি বিভাণ্ডকের মনে নারীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে সম্পূর্ণ নারীবিহীন এক বিচ্ছিন্ন অরণ্যে লালন-পালন করবেন। এইভাবেই ঋষ্যশৃঙ্গ বড় হতে থাকে। ঋষ্যশৃঙ্গ কোনোদিন নারীজাতিকে দেখেননি বা তাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও জানতেন না। তবে, তাঁর পিতা বিভাণ্ডকের দীক্ষায় তিনি এক অতুলনীয় যোগসাধনা লাভ করেন।
রাজা রোমপদ ও খরা দূরীকরণ
ঋষ্যশৃঙ্গ যে অরণ্যে বাস করছিলেন, তা ছিল অঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত, যার রাজা ছিলেন রোমপদ। একসময় রাজ্যে ভয়াবহ খরা ও দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। পরিস্থিতি ক্রমশ আরও সংকটজনক হয়ে ওঠে, এবং তখনই রোমপদ জানতে পারেন যে, অরণ্যের গভীরে এক মহাশক্তিশালী যোগী বাস করেন, যাঁর অলৌকিক শক্তি এই দুর্দশা দূর করতে পারে। রাজদূতদের মাধ্যমে রোমপদ বিভাণ্ডক ও ঋষ্যশৃঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হয় যে, ঋষ্যশৃঙ্গের অলৌকিক শক্তিই রাজ্যের দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে পারে।
কিন্তু বিভাণ্ডক বহির্বিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে পূর্বপরিচিত ছিলেন। তাই তিনি তাঁর পুত্রকে কঠোরভাবে আদেশ দেন যে, রাজ্য থেকে আসা কোনো প্রলোভনেই সে যেন প্রভাবিত না হয়। তিনি অরণ্যের চারপাশে এক সীমারেখা টেনে দেন—যা পরিচিত হয় “বিভাণ্ডক রেখা” নামে—এবং নির্দেশ দেন যে, ঋষ্যশৃঙ্গ কখনোই সেই সীমারেখা অতিক্রম না করে।
ঋষ্যশৃঙ্গকে অরণ্য থেকে বের করে অঙ্গরাজ্যের রাজধানীতে নিয়ে আসার জন্য, রাজা রোমপদ তাঁর শ্রেষ্ঠ রমণীদের প্রেরণ করেন। তবে, তারা ঋষি বিভাণ্ডকের ক্রোধের কথা জানত এবং তাই সরাসরি ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে যাওয়ার সাহস করেনি। পরিবর্তে, তারা অরণ্যের মধ্যেই একটি আশ্রম নির্মাণ করে এবং অপেক্ষা করতে থাকে, কবে বিভাণ্ডক তাঁর পুত্রকে একা রেখে কোথাও যাবে।
অবশেষে সেই সুযোগ আসে। বিভাণ্ডকের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে রমণীরা তরুণ ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে।
ঋষ্যশৃঙ্গ, যিনি জন্ম থেকে কেবল তাঁর পিতাকেই দেখেছেন, হঠাৎ করেই অপরিচিত, সুন্দরী এবং সুকৌশলী নারীদের দেখে বিস্মিত হন। তাঁর সরল ও নিষ্পাপ মনে কৌতূহল জন্মায়, এবং তিনি ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। রমণীরা তাঁকে নানা সুস্বাদু মিষ্টান্ন খাওয়ায়, বিলাসবহুল পোশাক পরায় এবং নানা উপায়ে তাঁকে সুখ-সুবিধার স্বাদ দেয়। আস্তে আস্তে তরুণ ঋষ্যশৃঙ্গ তাদের মোহে আবদ্ধ হয়ে পড়েন।
একদিন, মুগ্ধ ও প্রভাবিত ঋষ্যশৃঙ্গ সমস্ত শাস্ত্রবাণী ও বিভাণ্ডকের উপদেশ ভুলে যান। তিনি সেই রমণীদের সঙ্গে অরণ্য ছেড়ে নগরের পথে পা বাড়ান।
শান্তার সঙ্গে বিবাহ ও দশরথের যজ্ঞ
যেই মুহূর্তে ঋষ্যশৃঙ্গের পবিত্র চরণ রাজা রোমপদের রাজ্যে স্পর্শ করে, আকাশ থেকে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়, দীর্ঘদিনের খরার অবসান ঘটে। রোমপদ এই অলৌকিক ঘটনার ফলে আনন্দিত হন, কিন্তু একইসঙ্গে ঋষি বিভাণ্ডকের ক্রোধের আশঙ্কাও করেন। নিজেকে ও রাজ্যকে বিভাণ্ডকের অভিশাপ থেকে রক্ষা করার জন্য, রোমপদ ঋষ্যশৃঙ্গকে তাঁর পালিতা কন্যা শান্তার সাথে বিবাহের প্রস্তাব দেন। শান্তা ছিলেন রাজা দশরথ ও তাঁর স্ত্রী কৌশল্যার জ্যেষ্ঠ কন্যা, অর্থাৎ ভগবান রামের দিদি। যদিও জন্মসূত্রে দশরথ ও কৌশল্যার সন্তান, শান্তাকে দত্তক হিসেবে রাজা রোমপদ ও তাঁর রানি ভার্মদা লালন-পালন করেন। এই ঘটনা ঘটেছিল ভগবান রামের অবতার গ্রহণের বহু পূর্বে।
বিবাহের পর ঋষ্যশৃঙ্গ ও শান্তা পুনরায় অরণ্যে ফিরে যান এবং তপস্যার জীবনযাপন শুরু করেন। পরবর্তীতে, রাজা দশরথ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ঋষ্যশৃঙ্গকে অযোধ্যায় আমন্ত্রণ জানান এবং "পুত্র কামেষ্ঠি যজ্ঞ" সম্পন্ন করার জন্য অনুরোধ করেন। ঋষ্যশৃঙ্গের সম্পন্ন করা যজ্ঞ সফল হলে, দশরথ দেবতাদের আশীর্বাদে চার পুত্র লাভ করেন—শ্রী রাম, ভরত, লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন।
উপসংহার
ঋষ্যশৃঙ্গের জীবন এক বিরল ও বিস্ময়কর কাহিনি, যেখানে তপস্যা, প্রলোভন, শক্তি ও ভাগ্যের অনিবার্যতা একত্রে মিশে গেছে। তাঁর জন্ম যেমন অলৌকিক, তেমনই তাঁর কর্ম জীবনও অনন্য। তিনি শুধু এক মহান ঋষিই ছিলেন না, বরং ভগবান রামের ভগিনীপতি তথা পৌরাণিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রও।
(সূত্র: বাল্মীকী রামায়ণ ও মহাভারত)