শ্রীকৃষ্ণের মধুর লীলা খুব সহজেই আমাদের মন কেড়ে নেয়। দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এই লীলাগুলি শুনলে আমাদের আধ্যাত্মিকতার যাত্রায় তা সহায়তা করে। এই কাহিনীকেগুলি স্মরণ করলে অনায়াসেই আমাদের মন ঈশ্বরে আসক্ত হয়।
আসন্ন জন্মাষ্টমীতে ঘরে ঘরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন (অবতার গ্রহণ দিবস) উদ্যাপন করার আগে কৃষ্ণের দুষ্টু-মিষ্টি লীলাগুলি আরেকবার শুনে নিলে মন্দ হয় না। বহু যুগ ধরে শুনে আসা এই দিব্য লীলাগুলি বারবার শুনলেও মাধুর্যে ঘাটতি হয় না; উপরন্তু জ্ঞান, বিশ্বাস ও ভক্তি বৃদ্ধি করে আমাদের আধ্যাত্মিক যাত্রাপথকে আরও সুগম ও রসময় করে তোলে। এই প্রবন্ধে আমরা কৃষ্ণের বেশ কিছু প্রসিদ্ধ লীলা ও সেই লীলার অন্তর্নিহিত রহস্য বোঝার চেষ্টা করব।
ঐশ্বরিক লীলার উদ্দেশ্য
লীলা আলোচনা করার আগে এগুলির মূল উদ্দেশ্য বোঝা একান্ত প্রয়োজন। কৃষ্ণলীলার মূল উদ্দেশ্য হল – তাঁর প্রতি যাতে ভক্তদের প্রেমভক্তির ভিত্তি স্থাপিত হয় বা বৃদ্ধি পায়। ঈশ্বর অবতার গ্রহণ করলে আমরা তাঁর পবিত্র নাম, রূপ, গুণ, লীলা, ধাম এবং অনুচরদের পরিচয় পাই। এইসব বিষয় নিয়ে চিন্তন ও স্মরণের মাধ্যমে আমাদের হৃদয় পবিত্র হয় এবং আত্মার বাস্তবিক কল্যাণের পথে আমরা এগিয়ে যেতে পারি।
একটা কথা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাগতিক বুদ্ধি দিয়ে কিন্তু এই লীলাগুলির বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। বরং বুদ্ধি ভগবানের চরণে সমর্পন করে দৃঢ় বিশ্বাস, বিস্ময়বোধ, অলৌকিক কৃপা ও সর্বোপরি প্রকৃত প্রেমের দ্বারাই এই লীলাগুলির প্রকৃত আস্বাদন সম্ভব। কৃষ্ণলীলা অতি মধুর এবং তা ভক্তদের কিছু না কিছু শিক্ষা দেয়। তেমনই কিছু অপূর্ব লীলা বর্ণনা করে আমরা তার অর্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা করব।
শ্রীকৃষ্ণের জন্ম : দিব্যলীলার প্রারম্ভ
শ্রীকৃষ্ণের জন্মরহস্যই এক গভীর দিব্য লীলা। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে মধ্যরাত্রির স্তব্ধতা ভেদ করে শ্রীকৃষ্ণের জন্মগ্রহণ কোনও সাধারণ ঘটনা নয়।
লীলা বিবরণ
শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে আবির্ভূত হন শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী চতুর্ভুজ বিষ্ণুরূপে। ঐশ্বর্যপূর্ণ সেই রূপে তিনি দর্শন দেন দেবকী ও বসুদেবকে - তখন তাঁরা মথুরার অধিপতি অত্যাচারী কংসের কারাগারে বন্দী। দেবকী ও বসুদেবের অষ্টম সন্তান কংসকে হত্যা করবে – এমনই এক ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পর কংস তাঁদের আটক করে রেখেছিলেন। দেবকীর অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর যোগমায়া শক্তির মাধ্যমে এক নবজাতক শিশুতে রূপান্তরিত হন; যাতে দেবকী সন্তান জন্ম দেওয়ার মাতৃসুলভ অনুভূতি লাভ করতে পারেন। যোগমায়া শক্তি প্রয়োগ করে তিনি দেবকী ও বসুদেবকে তাঁর সেই ঐশ্বরিক প্রকাশের কথাও ভুলিয়ে দেন। তাঁরা শুধু এটুকুই জানলেন যে তাঁদের কোল জুড়ে এসেছে এক অপূর্ব সুন্দর সন্তান। এরপর দৈবশক্তির প্রভাবে সকল কারারক্ষী নিদ্রামগ্ন হয়, কারাগারের দরজা খুলে যায় এবং দৈব অনুপ্রেরণায় বসুদেব সদ্যোজাত কৃষ্ণকে একটি ঝুড়িতে রেখে সেটি মাথায় নিয়ে প্রবল প্লাবনের মধ্যেও যমুনা নদী পার হয়ে পৌঁছান গোকুলে। দৈব নির্দেশে বসুদেব পৌঁছে যান নন্দবাবার গৃহে। সেখানে তিনি অচেতন যশোদার পাশেই নবজাত কৃষ্ণকে রেখে দেন। যশোদার সদ্যোজাত কন্যাটিকে তুলে নিয়ে আবার কারাগারে ফিরে যান। সকলে এই কন্যাকেই দেবকীর অষ্টম সন্তান মনে করেন।
শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে আবির্ভূত হন শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী চতুর্ভুজ বিষ্ণুরূপে। ঐশ্বর্যপূর্ণ সেই রূপে তিনি দর্শন দেন দেবকী ও বসুদেবকে - তখন তাঁরা মথুরার অধিপতি অত্যাচারী কংসের কারাগারে বন্দী। দেবকী ও বসুদেবের অষ্টম সন্তান কংসকে হত্যা করবে – এমনই এক ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পর কংস তাঁদের আটক করে রেখেছিলেন। দেবকীর অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর যোগমায়া শক্তির মাধ্যমে এক নবজাতক শিশুতে রূপান্তরিত হন; যাতে দেবকী সন্তান জন্ম দেওয়ার মাতৃসুলভ অনুভূতি লাভ করতে পারেন। যোগমায়া শক্তি প্রয়োগ করে তিনি দেবকী ও বসুদেবকে তাঁর সেই ঐশ্বরিক প্রকাশের কথাও ভুলিয়ে দেন। তাঁরা শুধু এটুকুই জানলেন যে তাঁদের কোল জুড়ে এসেছে এক অপূর্ব সুন্দর সন্তান। এরপর দৈবশক্তির প্রভাবে সকল কারারক্ষী নিদ্রামগ্ন হয়, কারাগারের দরজা খুলে যায় এবং দৈব অনুপ্রেরণায় বসুদেব সদ্যোজাত কৃষ্ণকে একটি ঝুড়িতে রেখে সেটি মাথায় নিয়ে প্রবল প্লাবনের মধ্যেও যমুনা নদী পার হয়ে পৌঁছান গোকুলে। দৈব নির্দেশে বসুদেব পৌঁছে যান নন্দবাবার গৃহে। সেখানে তিনি অচেতন যশোদার পাশেই নবজাত কৃষ্ণকে রেখে দেন। যশোদার সদ্যোজাত কন্যাটিকে তুলে নিয়ে আবার কারাগারে ফিরে যান। সকলে এই কন্যাকেই দেবকীর অষ্টম সন্তান মনে করেন।
আধ্যাত্মিক শিক্ষা
- এই লীলা থেকে সর্বপ্রথম এই শিক্ষা পাওয়া যায় যে, ভগবানের কার্যকারণ বিশ্লেষণ করা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। আমাদের মনে রাখতে হবে – যে কোন দিব্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য বিশ্বাস ও ভক্তি একান্ত প্রয়োজন; আমাদের সীমিত মায়িক বুদ্ধি কোন দিব্য বিষয়ের তল খুঁজে পাবে না।
- ভগবান যখন ধরাধামে অবতীর্ণ হন,পরিস্থিতি অনুযায়ী উপযুক্ত এক-একটি দিব্য শক্তি তিনি প্রয়োগ করলেও তাঁর সমস্ত দিব্যশক্তি সবসময় তাঁর সঙ্গেই থাকে। কাজেই, “একটি ছোট্ট নবজাত শিশু কী করে এতসব অলৌকিক কাণ্ড ঘটাতে পারে“ – এই ধরণের প্রশ্ন থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত।
দামোদর লীলা : ঘটনা এক, শিক্ষা অনেক
এই স্নেহময় লীলায় যেমন মা যশোদা ও শিশু কৃষ্ণের বাৎসল্য প্রেম প্রকাশ পায়, তেমনি পতিত জীবের প্রতি ভগবানের করুণাও ফুটে ওঠে। সেই সঙ্গে আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য উদ্ঘাটিত হয়।
লীলা বিবরণ
নন্দগৃহে একদিন সকালে মা যশোদা ননী মন্থন করছিলেন; আর সেই সময় তাঁকে মাতৃস্নেহ অনুভব করানোর জন্য ছোট্ট শ্রীকৃষ্ণ টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে এসে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যশোদার মাতৃহৃদয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠল। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে দুধের ফুটে ওঠার শব্দ শুনে যশোদা কৃষ্ণকে নীচে নামিয়ে রেখে দুধটা সামলাতে ছুটে গেলেন। দুধের প্রতি মায়ের বেশী যত্ন দেখে ক্ষোভে শিশু কৃষ্ণ একটি লাঠি নিয়ে এসে একে একে দই ও মাখনের হাঁড়িগুলো ভেঙে ফেলল। তারপর সেই মাখন নিয়ে বানরদের খাওয়াতে শুরু করল। ফিরে এসে যশোদা হাঁ করে দেখলেন চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দই-মাখন আর ভাঙা হাঁড়ি। রেগে গিয়ে বেয়াড়া ছেলেকে শিক্ষা দিতে তিনি একটি লাঠি হাতে কৃষ্ণকে তাড়া করলেন। অনেক ছোটাছুটি করে অবশেষে ছেলেকে ধরে একটি উদূখল(শস্য পেষণী)-এর সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধতে গেলেন। আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল যে ছোট্ট কৃষ্ণকে বাঁধার জন্য দড়িটি দুই আঙুল ছোট হয়েছে! আরও দড়ি এনে সেই দড়ির সাথে জুড়ে দিয়েও দেখা গেল একই কাণ্ড – আবার দুই আঙুল ছোট পরছে! পরে রাধারাণীর শাড়ির একটি সুতো এনে দড়িতে যোগ করা হলে কৃষ্ণ নিজেই বাঁধা পড়ল। সেই সূত্রেই "দামোদর" নামটির উৎপত্তি – যার কোমরে (“উদর”) দড়ি (“দাম”) বাঁধা। বাঁধা অবস্থাতেই কৃষ্ণ উদূখলটিকে টানতে টানতে নিয়ে গেল দুটো গাছের মাঝখান দিয়ে যাতে দড়িটি ছেঁড়া যায়। গাছ দুটি মাটিতে ভেঙে পড়লে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন কুবেরের দুই পুত্র - নলকুবের ও মণিগ্রীব। তাঁদের পূর্বকৃত পাপকর্মের জন্য দেবর্ষি নারদ অভিশাপ দেন যে তাঁরা বৃক্ষরূপে জন্ম নেবেন। কৃষ্ণ তাঁদের সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়।
নন্দগৃহে একদিন সকালে মা যশোদা ননী মন্থন করছিলেন; আর সেই সময় তাঁকে মাতৃস্নেহ অনুভব করানোর জন্য ছোট্ট শ্রীকৃষ্ণ টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে এসে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যশোদার মাতৃহৃদয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠল। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে দুধের ফুটে ওঠার শব্দ শুনে যশোদা কৃষ্ণকে নীচে নামিয়ে রেখে দুধটা সামলাতে ছুটে গেলেন। দুধের প্রতি মায়ের বেশী যত্ন দেখে ক্ষোভে শিশু কৃষ্ণ একটি লাঠি নিয়ে এসে একে একে দই ও মাখনের হাঁড়িগুলো ভেঙে ফেলল। তারপর সেই মাখন নিয়ে বানরদের খাওয়াতে শুরু করল। ফিরে এসে যশোদা হাঁ করে দেখলেন চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দই-মাখন আর ভাঙা হাঁড়ি। রেগে গিয়ে বেয়াড়া ছেলেকে শিক্ষা দিতে তিনি একটি লাঠি হাতে কৃষ্ণকে তাড়া করলেন। অনেক ছোটাছুটি করে অবশেষে ছেলেকে ধরে একটি উদূখল(শস্য পেষণী)-এর সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধতে গেলেন। আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল যে ছোট্ট কৃষ্ণকে বাঁধার জন্য দড়িটি দুই আঙুল ছোট হয়েছে! আরও দড়ি এনে সেই দড়ির সাথে জুড়ে দিয়েও দেখা গেল একই কাণ্ড – আবার দুই আঙুল ছোট পরছে! পরে রাধারাণীর শাড়ির একটি সুতো এনে দড়িতে যোগ করা হলে কৃষ্ণ নিজেই বাঁধা পড়ল। সেই সূত্রেই "দামোদর" নামটির উৎপত্তি – যার কোমরে (“উদর”) দড়ি (“দাম”) বাঁধা। বাঁধা অবস্থাতেই কৃষ্ণ উদূখলটিকে টানতে টানতে নিয়ে গেল দুটো গাছের মাঝখান দিয়ে যাতে দড়িটি ছেঁড়া যায়। গাছ দুটি মাটিতে ভেঙে পড়লে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন কুবেরের দুই পুত্র - নলকুবের ও মণিগ্রীব। তাঁদের পূর্বকৃত পাপকর্মের জন্য দেবর্ষি নারদ অভিশাপ দেন যে তাঁরা বৃক্ষরূপে জন্ম নেবেন। কৃষ্ণ তাঁদের সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়।
আধ্যাত্মিক শিক্ষা
- এই লীলায় বিশুদ্ধ ভক্তির শক্তি প্রকাশ পায়। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হয়েও শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের প্রেমের সামনে নতজানু হন। তিনি ভক্ত-বশ্য।
- ভগবান তাঁর শ্রেষ্ঠ ভক্তদেরও পরীক্ষা নেন। ভক্তের কাছে ঈশ্বরের সেবা করার সুযোগ থাকলেও কি সে সংসারসামগ্রীকে বেছে নেয়?
- এই লীলা আরও শিক্ষা দেয় যে ঈশ্বরকে কোনো জাগতিক বস্তু দিয়ে বাঁধার প্রচেষ্টা বৃথা। ঈশ্বরকে বাঁধা যায় শুধুমাত্র ভক্তের প্রেম ও একনিষ্ঠ সেবা দিয়ে।
মাখনচোরের ধরা পড়া : দিব্য লীলার দ্বারা শিক্ষা
এই মজার লীলায় কৃষ্ণের দুষ্টুমি ও গোপীদের প্রেম প্রকাশ পায়। পরাভক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকারিণী হলেন রাধারাণী; তাঁর পরে এই গোপীরাই কিন্তু দিব্যপ্রেমের সর্বোচ্চ স্থানে আসীন।
লীলা বিবরণ
এক বুদ্ধিমতী গোপী কৃষ্ণকে মাখনচুরি করার সময় হাতেনাতে ধরে ফেলার জন্য কৌশল করে হাঁড়িটি একটি বিশেষ স্থানে রেখে দেয়। তারপর নিজেও আড়ালে লুকিয়ে থাকল যাতে সহজেই কৃষ্ণকে ধরতে পারা যায়। ওই গোপীর কুটিরে প্রবেশ করেই কৃষ্ণ মাখনের হাঁড়ি দেখতে পেয়ে গেল এবং তৃপ্তি করে তা খেতে শুরু করে দেয়। ঠিক তখনই পেছন থেকে এসে গোপী তাকে ধরে ফেলে। কৃষ্ণ কাকুতি-মিনতি শুরু করে - “আমায় ছেড়ে দাও!” কিন্তু গোপী নাছোড়বান্দা! এর আগেও বহুবার কৃষ্ণ এসে মাখন চুরি করে খেয়ে গেলেও যশোদা তা বিশ্বাস করতে চাননি। আজ তো চোর হাতেনাতে ধরা পড়েছে। গোপী ঠিক করে যে কৃষ্ণকে যশোদা মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে এই চুরির কথা জানাবে। ছোট্ট কৃষ্ণের হাত ধরে ঘোমটা-মুখে গোপী রওনা দেয় নন্দভবনের উদ্দেশ্যে। সেই দিব্য স্পর্শে গোপী পরমানন্দ অনুভব করে। ভাব-বিহ্বল হয়ে পড়ে সে। পারিপার্শ্বিক বাহ্যজগতের জ্ঞান তার প্রায় লোপ পেয়েছে; দিব্যভাবে এমনই বিভোর যে সে বুঝতেই পারে না - কখন ছোট্ট কৃষ্ণের বন্ধুরা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ঠিক তখনই অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে কৃষ্ণ নিজের হাত সরিয়ে তার এক বন্ধুর হাতটি গোপীর হাতে দিয়ে দেয়; দিব্যানন্দে নিমগ্ন গোপী এসব কিছুই টের পায় না। ওদিকে কৃষ্ণ ছুটতে ছুটতে এসে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছেই যশোদা মায়ের কোলে বসে পড়ে। তারপর কৃষ্ণের বন্ধুর হাত ধরে গোপী এসে হাজির সেখানে। গোপী অভিযোগ জানিয়ে বলল - “আমি কৃষ্ণকে মাখনচুরি করার সময় হাতেনাতে ধরেছি!” মুচকি হেসে যশোদা বললেন, “তোমার ঘোমটা সরিয়ে দেখো তুমি কার হাত ধরে আছো।” গোপী তো অবাক! এ কোন বালকের হাত ধরে আছে সে! এ যে কৃষ্ণ নয়! কিছুতেই বুঝতে পারল না গোপী – এমনটা হল কী করে!
এক বুদ্ধিমতী গোপী কৃষ্ণকে মাখনচুরি করার সময় হাতেনাতে ধরে ফেলার জন্য কৌশল করে হাঁড়িটি একটি বিশেষ স্থানে রেখে দেয়। তারপর নিজেও আড়ালে লুকিয়ে থাকল যাতে সহজেই কৃষ্ণকে ধরতে পারা যায়। ওই গোপীর কুটিরে প্রবেশ করেই কৃষ্ণ মাখনের হাঁড়ি দেখতে পেয়ে গেল এবং তৃপ্তি করে তা খেতে শুরু করে দেয়। ঠিক তখনই পেছন থেকে এসে গোপী তাকে ধরে ফেলে। কৃষ্ণ কাকুতি-মিনতি শুরু করে - “আমায় ছেড়ে দাও!” কিন্তু গোপী নাছোড়বান্দা! এর আগেও বহুবার কৃষ্ণ এসে মাখন চুরি করে খেয়ে গেলেও যশোদা তা বিশ্বাস করতে চাননি। আজ তো চোর হাতেনাতে ধরা পড়েছে। গোপী ঠিক করে যে কৃষ্ণকে যশোদা মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে এই চুরির কথা জানাবে। ছোট্ট কৃষ্ণের হাত ধরে ঘোমটা-মুখে গোপী রওনা দেয় নন্দভবনের উদ্দেশ্যে। সেই দিব্য স্পর্শে গোপী পরমানন্দ অনুভব করে। ভাব-বিহ্বল হয়ে পড়ে সে। পারিপার্শ্বিক বাহ্যজগতের জ্ঞান তার প্রায় লোপ পেয়েছে; দিব্যভাবে এমনই বিভোর যে সে বুঝতেই পারে না - কখন ছোট্ট কৃষ্ণের বন্ধুরা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ঠিক তখনই অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে কৃষ্ণ নিজের হাত সরিয়ে তার এক বন্ধুর হাতটি গোপীর হাতে দিয়ে দেয়; দিব্যানন্দে নিমগ্ন গোপী এসব কিছুই টের পায় না। ওদিকে কৃষ্ণ ছুটতে ছুটতে এসে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছেই যশোদা মায়ের কোলে বসে পড়ে। তারপর কৃষ্ণের বন্ধুর হাত ধরে গোপী এসে হাজির সেখানে। গোপী অভিযোগ জানিয়ে বলল - “আমি কৃষ্ণকে মাখনচুরি করার সময় হাতেনাতে ধরেছি!” মুচকি হেসে যশোদা বললেন, “তোমার ঘোমটা সরিয়ে দেখো তুমি কার হাত ধরে আছো।” গোপী তো অবাক! এ কোন বালকের হাত ধরে আছে সে! এ যে কৃষ্ণ নয়! কিছুতেই বুঝতে পারল না গোপী – এমনটা হল কী করে!
আধ্যাত্মিক শিক্ষা
- গোপীরা সারাক্ষণ কৃষ্ণের চিন্তায় ডুবে থাকে। তারা সকলেই কর্মযোগী - বাহ্যিক শরীর দিয়ে সংসারের কাজ করে, কিন্তু মন সবসময় ঈশ্বরের প্রতি নিবদ্ধ। এই লীলা প্রমাণ করে – ভক্তেরা যখন নিবিষ্ট চিত্তে ঈশ্বরের নিরন্তর স্মরণ করতে থাকে, তখন ঈশ্বর তাদের সাথে এমনই নানা লীলা করে দিব্য প্রেমের আনন্দ প্রদান করেন।
- ভগবান নানান কৌতুকপূর্ণ রসময় উপায়ে ভক্তদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করে থাকেন; যেমন – কৃষ্ণ গোপীদের বাড়ি থেকে মাখন চুরি করে খায়। এসব লীলার আসল কারণ ভক্তের হৃদয় চুরি করা; যাতে এই ঘটনাগুলি স্মরণ করে ভক্তেরা আরও বেশী করে ভগবানের সাথে ঘনিষ্ঠতা অনুভব করে।
- এই লীলা থেকে আমরা এটাও শিখি যে - বাহ্যিক ঘটনার ওপর বেশি জোর না দিয়ে কৃষ্ণলীলার অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যেটা দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এক দুষ্টু বালকের দৌরাত্ম্য, তা আসলে ভক্তের চিত্ত হরণ করার জন্য ভক্তবৎসল ভগবানের অভিনব পন্থা।
গোবর্ধন লীলা : শ্রীকৃষ্ণ এবার গিরিধারী
এই বিখ্যাত লীলায় কৃষ্ণের দিব্য শক্তি প্রকাশ পায়। ভক্তের বিপদে-আপদে যে ভগবান রক্ষা করেন এবং যোগক্ষেম (যা আধ্যাত্মিক সম্পদ আছে তার রক্ষা করা এবং যা নেই তার যোগান দেওয়া) বহন করেন – তারও সাক্ষ্য দেয় এই লীলা।
লীলা বিবরণ
দেবরাজ ইন্দ্রের পরিবর্তে গোবর্ধন পর্বতের পূজা করানোর জন্য ব্রজবাসীদের রাজী করিয়ে ফেলেন কৃষ্ণ। স্বয়ং পরমেশ্বর উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যদি লোকেরা অন্য দেবতাকে পূজা করে, তাহলে ভবিষ্যতে ভক্তেরা গীতার উপদেশ সম্পর্কে সংশয়ে পড়বে, যেখানে ঈশ্বরের প্রতি অনন্য ভক্তির কথা বলা হয়েছে। ফলে ব্রজবাসীরা গোবর্ধন পর্বতের পূজা শুরু করল - যা বিষ্ণুরই এক অবতার। এই সংবাদ পেয়ে দাম্ভিক দেবরাজ ইন্দ্র ক্রোধের বশবর্তী হলেন। ছোট্ট কৃষ্ণকে পরমেশ্বর রূপে না চিনতে পেরে তিনি ‘সম্বর্তক’ মেঘ পাঠালেন বৃন্দাবনে বন্যা ঘটানোর উদ্দেশ্যে। সেই মুষলধার বৃষ্টিতে ব্রজবাসীরা নিরাশ্রয় হয়ে পড়ল। তখন কৃষ্ণ নিজের বাঁ হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে গোবর্ধন পর্বত তুলে নিল এবং সমস্ত গ্রামবাসীদের তাদের পরিবার ও গরু-বাছুরসহ সেই পাহাড়ের নীচে আশ্রয় নিতে বলল। সমস্ত ব্রজবাসীকে ঈশ্বর ওই ভয়ঙ্কর দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেন। সাত দিন ও সাত রাত পরে ইন্দ্র তাঁর ভুল বুঝলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কৃষ্ণ তাঁকে ক্ষমা করে দিল। এই ঘটনার পর কিছু গ্রামবাসী কৃষ্ণের ঐশ্বরিক পরিচয় আন্দাজ করে। তারা কৃষ্ণকে সম্ভ্রমের চোখে দেখতে শুরু করে। তাদের সেই উপলব্ধি কৃষ্ণ নিজের যোগমায়া শক্তির প্রভাবে ভুলিয়ে দিল এবং আবার সবকিছু আগের মতই স্বাভাবিক হয়ে গেল। এই লীলার পর থেকে কৃষ্ণ “গিরিধারী” বা “গোবর্ধন ধারী” নামে খ্যাত হয় - যিনি গোবর্ধন পর্বতের ধারক।
আধ্যাত্মিক শিক্ষা
- এই লীলা আমাদের শিক্ষা দেয় - স্বর্গীয় দেবদেবীর উপাসনার চেয়ে পরম ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তিই শ্রেষ্ঠ।
- ঈশ্বর সবসময় তাঁর ভক্তদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন - এটা এই লীলার অন্যতম অনুরণন।
- ঈশ্বর যখন মানুষ রূপে পৃথিবীতে এসে মধুর ও স্নেহময় লীলা করেন, তাঁকে স্বর্গীয় দেবতারা পর্যন্ত চিনতে পারেন না। অতএব, তাঁর লীলা নিয়ে নিজেদের জাগতিক বুদ্ধি দিয়ে কাঁটা-ছেঁড়া না করে আমাদের উচিত কৃষ্ণলীলা উপভোগ করা ও সেই আনন্দে লীন থাকা।
শ্রীকৃষ্ণের উপর গোপীদের মধুর প্রতিশোধ : দিব্য প্রেমের মাধ্যমে শিক্ষা
এই লীলায় কৃষ্ণ ও গোপীদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ফুটে ওঠে। ব্রজগোপীরাই কৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠ নিষ্কাম ভক্ত।
লীলা বিবরণ
কৃষ্ণ ও তার বন্ধুদের দস্যিপনার প্রতিশোধ নিতে গোপীরা একটি পরিকল্পনা করে। গোপীরা মাখন বিক্রি করতে যাওয়ার রাস্তায় কৃষ্ণ তাদের আটকে দিত; তারপর “পথ-কর” হিসেবে মাখন দাবী করত। মাখন না পেলে গোপীদের আর যেতে দিত না। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণ ও তার বন্ধুরা প্রায়শই গোপীদের ঘর থেকে মাখন চুরি করে খেয়ে হাঁড়ি ভেঙে ফেলত! এবার মোক্ষম প্রতিশোধের পালা! গোপীরা আগে থেকেই তৈরী ছিল। কৃষ্ণ ও তার সখারা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পঁচিশ জন গোপী মিলে তাদের ঘিরে ধরল। গোপীরা সংখ্যায় বেশী হওয়ায় সহজেই কৃষ্ণ ও তার বন্ধুদের মাথার ঘন কেশের গোছা ধরে গাছের ডালে বেঁধে ফেলল। গোপীরা তো তাদের জয়ের আনন্দে আত্মহারা! হাততালি দিয়ে, হাসাহাসি করে বৃন্দাবনের মাখনচোরদের নিয়ে খুব ঠাট্টা-রসিকতা করল। মধুর প্রতিশোধ সম্পন্ন হল! কৃষ্ণ একটুও রেগে গেল না। বরং গোপীদের আনন্দ দেখে সে নিজেও খুব খুশী। কিন্তু, মিষ্টি হাসির সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিল দুষ্টু কৃষ্ণ - “এর জবাব কিন্তু আমি দেবই!”
আধ্যাত্মিক শিক্ষা
- এই লীলায় কৃষ্ণ ও ব্রজগোপীদের পরম প্রেম প্রকাশ পায়। প্রেম যখন সত্য, নিঃস্বার্থ, নিষ্কলঙ্ক – তখন ভগবানের সঙ্গে ভক্তের এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয় – যা কোনরকম সামাজিক বা প্রথাগত নিয়মের আওতায় পড়ে না।
- কৃষ্ণ ও গোপসখাদের সাথে গোপীদের এই ব্যবহার শুধুমাত্র প্রকৃত নিষ্কাম প্রেমের ক্ষেত্রেই সম্ভব; ভগবানকে একান্ত আপন না ভাবলে এমনটা কখনই হতে পারে না।
- একজন জীবাত্মা যখন তার সমস্ত জাগতিক ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে শুধু ঈশ্বরকেই তুষ্ট করতে চায়, ঈশ্বর তখনই সেই জীবাত্মাকে দিব্য প্রেম প্রদান করেন। কৃষ্ণলীলায় বহুবার দেখা যায় যে কিছু দুরাত্মা তাঁকে হত্যা করার বা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করলে তাদের তিনি বধ করেন। অথচ গোপীদের ক্ষেত্রে তিনি এত উদার! এর কারণ হল – ছদ্মলীলার আড়ালে গোপীদের আসল উদ্দেশ্য কৃষ্ণকে খুশী করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বীণাধারিণী : শ্রীকৃষ্ণের দিব্য ছদ্মবেশ
প্রকৃত ভক্তকে খুশী করার জন্য যে ভগবান কী কী করতে পারেন – তার প্রমাণ এই লীলা। এই লীলায় সেই ভক্তটি হলেন সকল ভক্তদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানাধিকারিনী রাধারাণী – যিনি শ্রীকৃষ্ণেরই হ্লাদিনী শক্তি। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জগদগুরু শ্রীকৃপালুজী মহারাজ একটি মান ভঞ্জন পদ রচনা করেন যেটা স্বামীজি বহুবার ব্যাখ্যা করেছেন।
লীলা বিবরণ
আমাদের দুষ্টু কৃষ্ণ রাধার সাথে দেখা করতে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েও অন্য এক গোপীর কাছে চলে যায়। যদিও রাধা ও কৃষ্ণ দুজনেই নিজেদের দিব্য স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত (যে রাধার থেকে বেশী নিষ্কাম সেবা করা আর কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়) – তবু রাধারাণী এই ঘটনায় যারপরনাই মর্মাহত! মান করে রাধা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে আর কোনদিন কৃষ্ণের মুখদর্শন করবে না। কৃষ্ণ অষ্ট মহাসখীদের কাছে সাহায্য চাইলে তারাও কৃষ্ণকে প্রত্যাখ্যান করে; তারা রাধারাণীর প্রতি একনিষ্ঠ এবং তারাও মনে করে যে এইবারে কৃষ্ণ বিরাট ভুল করেছে যা ক্ষমার যোগ্য নয়। কৃষ্ণ মনে মনে এক অসাধারন ফন্দি এঁটে ফেলে! সে এক সাধ্বীর ছদ্মবেশ নেয় - গেরুয়া শাড়ি, মাথার চুলে ফুলের মালা, হাতে বীণা। সাধ্বী সন্ন্যাসিনীর বেশে কৃষ্ণ অপেক্ষা করতে লাগল কুসুম সরোবরে - রাধার প্রিয় স্থানে। রাধা এল; এবং সেই সাধ্বীর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে মেতে গেল। সাধ্বীর হৃদয়গ্রাহী কথায় মুগ্ধ হয়ে রাধা তাঁকে নিজের গুরু হওয়ার অনুরোধ করে বসে। সাধ্বী সম্মত হলেন শুধু একটি শর্তে – ওই শ্যামবর্ণের সহজ-সরল ছেলেটির উপর আর রাগ করে থাকা চলবে না; ওকে এবারের মত একটু মাফ করে দিতে হবে; সেই সঙ্গে এতটা সময় ওর উপর রাগ করে থাকার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিতে হবে! রাধা সেই শর্ত মেনে নিলে আবার রাধাকৃষ্ণের মিলন হয়ে যায়।
আধ্যাত্মিক শিক্ষা
- আমাদের মত মায়িক জীবেরা কখনই রাধাকৃষ্ণের লীলার গভীরতা অনুধাবন করতে পারবে না। তাঁরা যা যা লীলা করেন – সেটা শুধুই একে অন্যকে বিনোদন দেওয়ার জন্য। রাধারাণী কৃষ্ণকে বিয়োগ বা বিরহ দেন যাতে কৃষ্ণের মনে সংযোগ বা মিলনের ইচ্ছার তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। আবার কৃষ্ণও একই কাজ করেন সেই একই কারণে।
- এই লীলা আবারও মনে করিয়ে দেয় যে, দিব্য ব্যক্তিত্বেরা যা যা লীলা করেন – আমাদের জাগতিক বুদ্ধি দিয়ে সেগুলির তল পাওয়া সম্ভব নয়।
শ্রীকৃষ্ণ ও সুদামা : দিব্য বন্ধুত্বের আখ্যান
এই হৃদয়স্পর্শী লীলা সমস্ত সামাজিক ভেদাভেদের ব্যবধান তুচ্ছ করে প্রকৃত বন্ধুত্ব ও একনিষ্ঠ ভক্তির মহিমা তুলে ধরে।
লীলা বিবরণ
সুদামা ছিল কৃষ্ণের শৈশবের প্রিয় বন্ধু। গুরু সন্দীপনি মুনির আশ্রমে পড়াকালীন সুদামা একটি গুরুতর ভুল করে বসে - যার ফলে গুরুপত্নী তাকে আজীবন দরিদ্র থাকার অভিশাপ দেন। সেই সময় থেকেই সুদামার জীবন অভাব-অনটনে কাটতে থাকে। এক চরম অর্থকষ্টের দিনে সুদামার স্ত্রী তার কাছে অনুরোধ জানায় সে যেন দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণের কাছে গিয়ে কিছু সাহায্য চায়। তা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সুদামা অজুহাত খোঁজার চেষ্টা করে – এতদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলে কি একদম খালি হাতে যাওয়া যায়? কিছু উপহার তো দেওয়া উচিত; সেটুকু সাধ্যও নেই আমাদের। সুদামার স্ত্রী তার কোঁচড়ে শুকনো চিঁড়ে বেঁধে দিয়ে সেগুলো কৃষ্ণকে দিতে বলে। দরিদ্র সুদামা যখন কৃষ্ণের দরবারে পৌঁছাল, অন্যান্যরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করলেও কৃষ্ণ তাকে গভীর আন্তরিকতা ও সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা করল। এমনকি, সুদামার চরণদুটি কৃষ্ণ নিজের চোখের জলে ধুয়ে দেয়। অন্তর্যামী কৃষ্ণ জানতে চাইল – “কিরে, বৌদি কী পাঠাল আমার জন্য?” লজ্জায়-সঙ্কোচে সুদামা ওই সামান্য চিঁড়ে বের করতে পারে না। কিন্তু কৃষ্ণ তো ছাড়ার পাত্র নয়। ঠিক খুঁজে বের করে সেই থলি থেকে ওই শুকনো চিঁড়ে তৃপ্তি নিয়ে আস্বাদন করল শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণ একবারও জিজ্ঞাসা করল না যে কেন সুদামা দ্বারকায় এসেছে; আর সুদামাও সঙ্কোচ কাটিয়ে কিছু বলতে পারে না। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর আর সুদামার বিস্ময়ের সীমা রইল না। কোথায় তার ভগ্ন কুটির! সে তো যেন রাতারাতি জাদুবলে এক অপূর্ব প্রাসাদে রূপান্তরিত হয়েছে। দারিদ্র্যের আর কোন চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। সুদামার বুঝতে সময় লাগল না যে এগুলি সবই কৃষ্ণের দিব্য কৃপার ফল।
আধ্যাত্মিক শিক্ষা
- নিঃস্বার্থ ভক্তি ও ঈশ্বরের অপরিসীম কৃপার পরিচয় দেয় এই লীলা। আমরা যখন ঈশ্বরকে কোন উপহার দিই – অর্থাৎ ভক্তির সঙ্গে তাঁকে কোন বস্তু অর্পণ করি, তিনি কিন্তু সেই বস্তুর আর্থিক বা জাগতিক মূল্য বিচার করেন না – বরং কতখানি খাঁটি ভক্তি ও ভালোবাসার সাথে তা অর্পণ করা হল – সেটাই দেখেন।
- ঈশ্বর আমাদের সঠিক পথ দেখিয়ে দেন ঠিকই; কিন্তু আমরা কোন পথে চলব – তার সিদ্ধান্ত আমাদের উপরেই ছেড়ে দেন। কেউ আগে ভুল করেছিল বলে ঈশ্বর কখনও ক্ষোভ পুষে রাখেন না; বরং আমাদের ভুল শুধরানোর সুযোগ দেন।
- আমরা প্রত্যেকেই আমাদের প্রতিটি কৃতকর্মের জন্য দায়ী – তা সে ছোটবেলায় করা কাজই হোক না কেন। প্রত্যেককেই তার কর্মফল ভোগ করতে হয়।
উপসংহার : শ্রীকৃষ্ণ লীলার চিরন্তন বার্তা
জন্মাষ্টমী উদ্যাপনের আগে যেন আমরা শ্রীকৃষ্ণের এই দিব্যলীলায় নিজেদের চেতনার অবগাহন করে নিই। প্রতিটি লীলাই আধ্যাত্মিক মূল্যে সমৃদ্ধ – ভক্তি, নিষ্কামতা ও সেই রহস্যময় দিব্য প্রেমের ভাণ্ডার।
এই লীলাগুলি পড়ে যদি সত্যিই আমরা লাভবান হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখি - তার জন্য চাই ভক্তিযুক্ত হৃদয় ও লীলারহস্য উপলব্ধি করতে পারার উপযুক্ত এক উন্মুক্ত মন। স্বামী মুকুন্দানন্দ বারবার আমাদের এটাই মনে করিয়ে দেন – জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি সরিয়ে রেখে একমাত্র প্রেম ও ভক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা ঠিকভাবে কৃষ্ণলীলার মাধুর্য অনুভব করতে পারব।
শুধু জন্মাষ্টমী উপলক্ষে নয়, আমরা যেন এই লীলাগুলির মধুরতা ও শিক্ষাকে আমাদের সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক যাত্রাপথের পাথেয় করে নিতে পারি।