জগন্নাথদেবের আবির্ভাব সম্পর্কে বিভিন্ন শাস্ত্রে নানা কাহিনী পাওয়া যায়। এখানে আমরা স্কন্দ পুরাণে বর্ণিত পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্য এবং ওড়িশার বহুল প্রচারিত জগন্নাথের জনপ্রিয় কাহিনী উল্লেখ করছি।
সত্য যুগে সূর্যবংশীয় এক মহান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অবন্তী নগরে (বর্তমান উজ্জয়িনীতে) রাজত্ব করতেন। ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত এই রাজা ছিলেন ন্যায়পরায়ণ ও ধর্মনিষ্ঠ। তিনি রাজ্য শাসন করতেন পরম নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে। একবার একটি পূজানুষ্ঠান চলাকালীন মন্দিরের গর্ভগৃহে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন শ্রদ্ধাভরে সমবেত রাজপুরোহিত, ঋষি, কবি ও জ্যোতিষীদের প্রশ্ন করেন -"এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর জগন্নাথদেবকে আমরা কোথায় স্বচক্ষে দর্শন করতে পারি?"
রাজার প্রশ্নের উত্তরে সভায় উপস্থিত এক জ্ঞানী তীর্থযাত্রী সপ্রতিভ উত্তর দেন -
"হে মহোদয়গণ, হে পবিত্র তীর্থের অনুসন্ধানীগণ, আমি বহু স্থানে ভ্রমণ করেছি ও বহু তীর্থস্থান সম্পর্কে শ্রবণ করেছি। ভারত উপমহাদেশে এক পবিত্র স্থান আছে—ওদ্রদেশ (উৎকল, বর্তমান ওড়িশা), যা দক্ষিণ মহাসাগরের তীরে অবস্থিত। সেখানেই রয়েছে এক মহাপবিত্র তীর্থ - শ্রীপুরুষোত্তম ক্ষেত্র।"
"হে মহোদয়গণ, হে পবিত্র তীর্থের অনুসন্ধানীগণ, আমি বহু স্থানে ভ্রমণ করেছি ও বহু তীর্থস্থান সম্পর্কে শ্রবণ করেছি। ভারত উপমহাদেশে এক পবিত্র স্থান আছে—ওদ্রদেশ (উৎকল, বর্তমান ওড়িশা), যা দক্ষিণ মহাসাগরের তীরে অবস্থিত। সেখানেই রয়েছে এক মহাপবিত্র তীর্থ - শ্রীপুরুষোত্তম ক্ষেত্র।"
"এই অঞ্চলে," তিনি বলতে থাকেন, "অরণ্যে আবৃত নীলগিরি পর্বত অবস্থিত। সেই পর্বতের মধ্যভাগে আছে এক কল্পবৃক্ষ - যার ছায়া তিন কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। এই কল্পবৃক্ষের ছায়ার আশ্রয়ে সমস্ত পাপস্খালন হয়। এর পশ্চিমে রয়েছে প্রসিদ্ধ রৌহিণ কুণ্ড – যেখানে এখনও সৃষ্টির আদি সময়ের জল আছে। এই কুণ্ডের জল স্পর্শমাত্রেই মোক্ষ লাভ হয়। পূর্বদিকে একটি শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি বিরাজমান, যেটি নীলকান্তমণি (নীলা) দ্বারা নির্মিত, এবং সেইজন্যই তাঁকে ‘নীলমাধব’ নামে অভিহিত করা হয় - যা শ্রীকৃষ্ণের নীলরূপকেই নির্দেশ করে।"
"আর পশ্চিমদিকে একটি পথ আছে যার দুই ধারে শবর জাতির (শিকারি সম্প্রদায়) বসবাস", তিনি আরও বলেন, "সেই পথ চলে গিয়েছে নীলমাধব মন্দিরের দিকে। সেখানেই শঙ্খ, চক্র ও গদা হাতে জগন্নাথদেব বিরাজ করছেন করুণাময় রূপে – যিনি সংসারের সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি প্রদান করেন।"
তীর্থযাত্রী জানান যে তিনি সম্পূর্ণ এক বর্ষকাল শ্রীপুরুষোত্তম ক্ষেত্রে অতিবাহিত করেন। ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য কঠোর তপস্যা ও আচারানুষ্ঠানে নিমগ্ন থেকে বনভূমিতেই বাস করেছিলেন। তিনি আরও জানান যে সেই স্থানে অপার্থিব সুবাস ছড়িয়ে থাকে; কল্পবৃক্ষ থেকে দেবদূতেরা নেমে এসে ফুল বর্ষণ করেন - এমন দৃশ্য পৃথিবীর আর কোনও বিষ্ণুমন্দিরে দেখা যায় না।
পরিশেষে তিনি একটি প্রাচীন উপাখ্যান শোনান – যেখানে একটি কাক - যে কিনা নীচু প্রজাতির জীব হয়েও এবং কোনরকম জ্ঞান বা যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও, কেবল নীলমাধবের দর্শন করেই মোক্ষ লাভ করে।
এমন অপার্থিব বর্ণনায় গভীরভাবে আপ্লুত হয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নিজের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি জানান যে শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় আজ তাঁর আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটল। রাজার মধ্যে নিষ্কলুষ ভক্তি জেগে উঠেছে দেখে, রাজার মধ্যে সদ্য প্রকাশিত আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতিজ্ঞা প্রত্যক্ষ করে সেই তীর্থযাত্রী আচমকা অন্তর্ধান হয়ে যান। এই অভূতপূর্ব ঘটনায় বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন।
নীলমাধবের খোঁজ
নীলমাধবের সন্ধান পেতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তাঁর বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণ পুরোহিত বিদ্যাপতিকে এই গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেন। এক দীর্ঘ ও কণ্টকাকীর্ণ যাত্রায় রওনা হন বিদ্যাপতি – বহু পথ অতিক্রম করে ঘন অরণ্যের ভিতর দিয়ে শবর-অধ্যুষিত এলাকায় এসে উপস্থিত হন তিনি। সেই নির্জন অগম্য স্থানে বিদ্যাপতির সাক্ষাৎ হয় বিশ্বাবসুর সঙ্গে; যিনি ছিলেন শবর জাতির প্রধান। শুরুতে কিছু সন্দেহ থাকলেও বিশ্বাবসু আন্তরিকভাবে বিদ্যাপতিকে স্বাগত জানান, তাঁকে আশ্রয় দেন ও যথাযথ আপ্যায়ন করেন।
বিশ্বাবসুর আশ্রয়ে থাকাকালীন তাঁর কন্যা ললিতার সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে তোলেন বিদ্যাপতি। তাঁদের সম্পর্ক ক্রমশ গভীরতর হয়ে বিবাহবন্ধনে পরিণত হয়। বিদ্যাপতি লক্ষ্য করেন যে বিশ্বাবসু প্রায়ই চুপিসারে অরণ্যে চলে যান এবং বহুক্ষণ পরে ফেরেন। বিদ্যাপতির মন কৌতূহলী হয়ে ওঠে। একদিন তিনি ললিতাকে জিজ্ঞাসা করেন এই অদ্ভুত আচরণের কারণ। ললিতা জানায় যে অরণ্যের ভিতরে নীলমাধব বিরাজ করেন সাধারণ মানুষের লোকচক্ষুর আড়ালে; তাঁর পিতা সেই নীলমাধবের পূজা করতে যান।
নীলমাধবের বিগ্রহ দর্শন করার জন্য বিদ্যাপতি আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বিশ্বাবসু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন সেই স্থানের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য; কিন্তু কন্যা ললিতার অনুনয়ে শেষমেশ সম্মত হন। তবে স্থানটি গোপন রাখার জন্য তিনি বিদ্যাপতির চোখে কাপড় বেঁধে অরণ্যের গভীরে নিয়ে যান। বুদ্ধিমান বিদ্যাপতি পথে সর্ষের দানা ছড়াতে ছড়াতে যেতে থাকেন। এই বীজগুলি অঙ্কুরিত হয়ে সেই দেবস্থানে যাওয়ার পথ দেখাবে ভবিষ্যতে।
অবশেষে সেই গুপ্ত গুহার ভিতরে পৌঁছে নীলমাধবের দর্শন লাভ করে অভিভূত হয়ে যান বিদ্যাপতি। তিনি সেখান থেকে গোপনে কিছু প্রসাদ ও পূজিত বস্তু নিয়ে নেন যা তিনি এই বিগ্রহ দর্শনের প্রমাণ স্বরূপ রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে দেখাতে পারেন। এরপর বিদ্যাপতি নিজের রাজ্যে প্রত্যাগমন করেন। ততদিনে সেই সর্ষের দানাগুলি অঙ্কুরিত হয়ে নীলমাধবের বিরাজ স্থানে পৌঁছানোর গোপন পথ তৈরী করে দিয়েছে।
দিব্য সংযোগ ও জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণ
বিদ্যাপতির আবিষ্কারের সংবাদ পৌঁছে যায় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। আনন্দে ও ভক্তিতে উদ্বেল রাজা তাঁর রাজপারিষদ, ব্রাহ্মণ ও সৈন্যদের নিয়ে রওনা হন নীলমাধবকে অবন্তী নগরে নিয়ে আসার জন্য। সেই সর্ষের চারা-গজানো পথ অনুসরণ করে অবশেষে তাঁরা পৌঁছান সেই রহস্যময় গুহার দ্বারে। কিন্তু নীলমাধব তো আর সেখানে নেই! দেবমূর্তির অন্তর্ধান হয়েছে। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ভেঙে পড়েন; তাঁর হৃদয় বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়। তিনি স্থির করেন - যদি নীলমাধব নিজেই আত্মপ্রকাশ না করেন, তাহলে তিনি আজীবন উপবাস ব্রত ধারণ করবেন।
এই চরম দুর্দশার মুহূর্তে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্বপ্নে আবির্ভূত হন ভগবান বিষ্ণু - এক ঐশ্বরিক পরিকল্পনা প্রকাশ করতে। ভগবান বিষ্ণু রাজাকে আদেশ দেন যাতে তিনি পুরীতে এক মহামন্দির নির্মাণ করে সেখানে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এই বিগ্রহগুলি সাধারণ নয়;
তাঁরা হবেন দারু অর্থাৎ এক পবিত্র কাষ্ঠখণ্ড থেকে নির্মিত। ভগবান জানান, সেই কাষ্ঠখণ্ড সমুদ্র থেকে ভেসে আসবে, যা থেকে নির্মাণ হবে দিব্য মূর্তিগুলি। এই কারণেই ভগবান জগন্নাথকে বলা হয় "দারু ব্রহ্মণ", অর্থাৎ কাঠের রূপে ব্রহ্মের প্রকাশ।
তাঁরা হবেন দারু অর্থাৎ এক পবিত্র কাষ্ঠখণ্ড থেকে নির্মিত। ভগবান জানান, সেই কাষ্ঠখণ্ড সমুদ্র থেকে ভেসে আসবে, যা থেকে নির্মাণ হবে দিব্য মূর্তিগুলি। এই কারণেই ভগবান জগন্নাথকে বলা হয় "দারু ব্রহ্মণ", অর্থাৎ কাঠের রূপে ব্রহ্মের প্রকাশ।
ভগবান বিষ্ণুর স্বপ্নাদেশ মেনে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এক মহা অনুসন্ধানে বের হন সেই দিব্য দারু অর্থাৎ পবিত্র কাষ্ঠখণ্ড খুঁজে পেতে। বহু অন্বেষণের পর অবশেষে তিনি সমুদ্রে ভেসে আসা সেই কাষ্ঠখণ্ড আবিষ্কার করেন – যা নিয়ে তিনি পুরীতে আসেন। সেই সময়ই এক বৃদ্ধ কাঠমিস্ত্রি রূপে আবির্ভূত হন দেবতাদের স্থপতি বিশ্বকর্মা, যিনি রাজাকে পরিচয় দেন অনন্ত মহারাণা নামে। তিনি মূর্তি নির্মাণে রাজী হন, তবে একটি কঠোর শর্ত দেন - সমগ্র নির্মাণপ্রক্রিয়া হবে সম্পূর্ণ গোপনে। মূর্তিনির্মাণ চলাকালীন কেউ সেই স্থানে প্রবেশ করবে না, কেউ কোন প্রশ্ন করবে না।
কিন্তু নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই কৌতূহলবশত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ও রাণী সেই কক্ষে প্রবেশ করেন, যেখানে বিশ্বকর্মা নির্জনে মূর্তি নির্মাণে রত ছিলেন। এই প্রতিজ্ঞাভঙ্গের দরুন বিশ্বকর্মা মূর্তি অসমাপ্ত রেখেই অন্তর্ধান হন। তবে সেই অসম্পূর্ণ মূর্তিতেই বিরাজ করতে থাকেন জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা - তাঁদের অনন্য রূপে। এই দিব্য বিগ্রহগুলি পরে প্রতিষ্ঠিত হয় পুরীর নবনির্মিত মন্দিরে এবং তাঁদের পূজা শুরু হয়।
নীলমাধবের উপাখ্যান এবং পুরীতে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের ইতিহাস ওড়িশার সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই কাহিনী থেকে বোঝা যায় যে জগন্নাথদেবের পূজাপ্রক্রিয়া কিভাবে বিভিন্ন জাতি, সমাজ ও আচার-অনুশীলনের মাধ্যমে এক সর্বজনীন আরাধনা হয়ে উঠেছে। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন, বিদ্যাপতি ও শবরগণের এই গাথা এক অবিচল বিশ্বাস ও ভক্তির প্রতীক - যা আজও কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে ধ্বনিত হয়ে চলে, যাঁরা জগন্নাথদেবকে শ্রদ্ধা ও প্রেমের সঙ্গে ভক্তি করেন।
জগন্নাথ স্বামী: ওড়িশার সংস্কৃতি ও পরিচয়ের হৃদয়স্পন্দন
ওড়িশার সংস্কৃতি, সাহিত্য, কাব্য, নৃত্য - বিশেষ করে ওড়িশি, এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পরতে নিবিড়ভাবে গাঁথা রয়েছেন শ্রীজগন্নাথ স্বামী। তিনি শুধু ঈশ্বর নন, ওড়িয়া জাতিসত্তার কেন্দ্রবিন্দু ও প্রাণভাষ্য। ওড়িশার মানুষেরা তাঁকে এতটা আপন করে নিয়েছেন যে ভালোবাসার টানে তাঁকে নানা নামে ডাকেন -‘জগ্গা’ (জগন্নাথের সংক্ষিপ্ত রূপ), ‘কালিয়া’ (তাঁর শ্যামবর্ণ রূপের জন্য), বা ‘চক্কা আঁখি’ (যাঁর চক্ষুদ্বয় রথের চাকার মতো বড়ো)। প্রচলিত আছে - রথযাত্রার সময় জগন্নাথদেবের রথ কিছুতেই গতি পায় না, যতক্ষণ না তাঁর ভক্তেরা স্নেহের ভর্ৎসনা করেন! এই মধুর ঠাট্টা ও স্নেহময় রাগ ভগবান এতটাই উপভোগ করেন যে তিনি বারবার থেমে পড়েন, যাতে আরও একটু ভালোবাসার ভর্ৎসনা শোনেন ভক্তদের মুখে।
ওড়িশার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে বহু বিশিষ্ট পণ্ডিত ও সাধকেরা জগন্নাথদেবের দিব্য লীলা ও মহিমার প্রচারে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণীয় হলেন সরল দাস ও জগন্নাথ দাস। সরল দাস রচিত ওড়িয়া মহাভারত এবং জগন্নাথ দাস প্রণীত ওড়িয়া ভাগবত - এই দুই গ্রন্থেই সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে জগন্নাথদেবের দিব্য উৎস এবং তাঁকে শ্রীকৃষ্ণেরই এক মহিমাময় রূপ বলে মনে করা হয়েছে। এই গ্রন্থগুলি কেবল ধর্মীয় বক্তব্য নয়, বরং বহুধর্মীয় ধারার মধ্যে জগন্নাথের অন্তর্নিহিত প্রভাব ও যুগ যুগ ধরে বহু ভক্তের জগন্নাথের প্রতি অটল বিশ্বাসের সাক্ষ্য বহন করে।