Log in
English

সচেতন খাদ্যতালিকা: মনের উপর খাদ্যের প্রভাব

Apr 30th, 2025 | 4 Min Read
Blog Thumnail

Category: Nature and Wellbeing

|

Language: Bangla

আপনার মনে কি কখনো এই প্রশ্ন জেগেছে যে আপনার পছন্দের খাবার আপনার মন ও শরীরকে কীভাবে প্রভাবিত করে? প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা আয়ুর্বেদ খাবারকে একটি অনন্য দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেণীবদ্ধ করে। আমাদের অন্তর্নিহিত অবস্থার উপর প্রভাবের ভিত্তিতে খাদ্যকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে: সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক।  

১। সাত্ত্বিক খাবার : মন ও শরীরের পুষ্টি 

কল্পনা করুন এক খাদ্যতালিকা যা সতেজ ও পুষ্টিকর উপাদানে সমৃদ্ধ। সাত্ত্বিক খাবার এই শ্রেণীতে পড়ে। রসালো ফল, রঙিন সবজি, স্বাস্থ্যকর শস্য, বাদাম, বীজ এবং দুগ্ধজাত পণ্য এই খাবারের অন্তর্ভুক্ত। এই ধরণের খাদ্য স্পষ্ট চিন্তাভাবনা, শান্তি ও সামগ্রিক সুস্থতা বৃদ্ধি করে। সাত্ত্বিক খাদ্য শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে এবং মন ও শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।  

২। রাজসিক খাবার : স্বাদের মোহ 

রাজসিক খাবার স্বাভাবিকভাবে ক্ষতিকারক নয়, তবে অতিরিক্ত গ্রহণ অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে পারে। এই খাবারগুলোর স্বাদ অত্যন্ত তীব্র হয় – অতিরিক্ত ঝাল, নোনতা বা মিষ্টি। এগুলো আমাদের স্বাদগ্রন্থিকে আকৃষ্ট করে, তবে অতিরিক্ত গ্রহণ অস্থিরতা, চঞ্চলতা এমনকি আক্রমণাত্মক মনোভাবের সৃষ্টি করতে পারে। 

৩। তামসিক খাবার : এড়িয়ে চলাই উচিত 

তামসিক খাবার সাধারণত স্বাস্থ্য ও সুস্থতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে বাসি, প্রক্রিয়াজাত খাবার, মাংস, মাছ এবং ডিম অন্তর্ভুক্ত। আয়ুর্বেদ অনুসারে, এই খাবারগুলো শরীরে জড়তা, অলসতা ও নেতিবাচকতা বাড়াতে পারে এবং মানসিক স্বচ্ছতায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সুস্থ ও সচেতন জীবনযাপনের জন্য এগুলো পরিহার করাই ভালো।  

শাকাহারী শরীরে পুষ্টির জোগান 

আয়ুর্বেদ একটি উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্যাভ্যাসকে গুরুত্ব দেয়। কলাই, মসুর প্রভৃতি ডাল, শিম জাতীয় উদ্ভিজ্জ এবং দুগ্ধজাত পণ্য চমৎকার প্রোটিনের উৎস। এগুলো শরীরের গঠন ও বৃদ্ধি বজায় রাখতে সাহায্য করে, পাশাপাশি মাংসজাত খাবারের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব এড়াতেও সহায়ক।  

চর্বি: প্রয়োজনীয় কিন্তু সন্তুলিত 

অনেকের ধারণা চর্বি ক্ষতিকর, তবে বাস্তবে এটি আমাদের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চর্বি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, হরমোন উৎপাদন ও শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। স্বাস্থ্যকর চর্বির জন্য বাদাম, বীজ ও অ্যাভোকাডোর মতো অসম্পৃক্ত চর্বির উৎস গ্রহণ করুন। পাশাপাশি, দুগ্ধজাত পণ্যে থাকা স্যাচুরেটেড ফ্যাট (সম্পৃক্ত চর্বির) নিয়ন্ত্রণ করুন, যাতে কোলেস্টেরল বেড়ে গিয়ে স্বাস্থ্যের ক্ষতি না হয়।  

মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস (অণুপুষ্টি উপাদান) : ভিটামিন ও খনিজের শক্তি 

সতেজ ফল ও সবজি ভিটামিন ও খনিজের এক অসাধারণ উৎস, যা আমাদের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। এই গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টগুলো পূর্ণমাত্রায় গ্রহণের জন্য রান্নার পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ। বাষ্পে সিদ্ধ বা হালকা ভাজা করলে অধিকাংশ ভিটামিন ও খনিজ উপাদান সংরক্ষিত থাকে, যা অতিরিক্ত তাপ বা দীর্ঘ সময় রান্নার ফলে নষ্ট হতে পারে।  

ফলমূল : শরীরের প্রাকৃতিক পরিশোধক ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উৎস

ফল আমাদের খাদ্যতালিকার একটি অপরিহার্য অংশ। এগুলো হজমপ্রক্রিয়াকে সহায়তা করে এবং শরীরের অম্ল-ক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখে। এছাড়াও, ফল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা ক্ষতিকারক ফ্রি রাডিক্যালের (মুক্ত মৌল)  বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং দীর্ঘমেয়াদী  রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। সুস্থতার জন্য বিভিন্ন ধরনের ফল গ্রহণ করুন, বিশেষত গাঢ় রঙের ফল, যেগুলোতে বেশি পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে।  

আহার বিধি : শুধু খাদ্য নয়, খাদ্যগ্রহণের শৈলীও  গুরুত্বপূর্ণ

আয়ুর্বেদ ও প্রকৃতিশাস্ত্র (ন্যাচারোপ্যাথি) শুধুমাত্র কতটা ক্যালোরি  গ্রহণ করা হচ্ছে তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং খাদ্যাভ্যাসকে একটি সম্পূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে। এই সিদ্ধান্তের অনুসারে "আহার বিধি" শুধুমাত্র কী খাওয়া উচিত তা নিয়েই নয়, বরং খাবারের গুণগত মান, পরিমাণ এবং কীভাবে খাওয়া উচিত – সবকিছুই নির্ধারিত হয় ব্যক্তির হজমক্ষমতার উপর ভিত্তি করে।  

খাদ্য উপলব্ধি : স্বাদের আনন্দ, শক্তির উৎস, হজমের প্রক্রিয়া

আয়ুর্বেদ অনুযায়ী প্রতিটি খাবারের একটি অনন্য স্বাদ, শক্তি এবং হজমের উপর আলাদা প্রভাব রয়েছে। আমাদের হজমশক্তি বা (জঠরাগ্নি) এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি এটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ খাদ্য সংমিশ্রণের কারণে অতিরিক্ত চাপে পড়ে, তবে অজীর্ণতা থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদী  রোগও সৃষ্টি হতে পারে।  

খাদ্যবিন্যাস : হালকা বনাম ভারী

আয়ুর্বেদ খাবারকে হজমক্ষমতার ভিত্তিতে দুই ভাগে ভাগ করে – হালকা ও ভারী। যেমন, মুগ ডাল ও বাসমতি চাল সহজপাচ্য এবং বেশি পরিমাণেও ক্ষতিকর হয় না। অন্যদিকে, কালো ছোলা ও কাঁচা সবজি হজমের জন্য অধিক শক্তিশালী জঠরাগ্নির প্রয়োজন হয়। তাই এগুলো সংযত পরিমাণে গ্রহণ করাই শ্রেয়।  

হজম সহায়ক খাদ্য নির্বাচন ও শ্রেণীবিন্যাস

আয়ুর্বেদের মৌলিক গ্রন্থ “চরক সংহিতা” খাবারকে বিভিন্ন উপায়ে শ্রেণীবদ্ধ করেছে—  
  • উৎপত্তি অনুযায়ী: শস্য, ডাল, সবজি, ফল ইত্যাদি। 
  • আকার অনুযায়ী: যা খাওয়া যায়, পান করা যায়, চেটে খাওয়া যায় এবং চিবিয়ে খাওয়া যায়। 
  • প্রভাব অনুযায়ী: স্বাস্থ্যকর (হিতকর) বা অস্বাস্থ্যকর (অহিতকর)।  

স্বাস্থ্যকর বনাম অস্বাস্থ্যকর খাবার

একটি সুস্থ জীবনের জন্য এমন খাবার নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ, যা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং অসামঞ্জস্য দূর করে। লাল চাল, সবুজ মুগ ডাল ও গরুর দুধ হিতকর খাদ্যের মধ্যে পড়ে, যা শরীরের জন্য উপকারী। অন্যদিকে, বন্য যব ও ভেড়ার দুধ অহিতকর হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো।  

সুস্থ জীবনের জন্য খাদ্যাভ্যাসে আয়ুর্বেদ ও ন্যাচারোপ্যাথির সমন্বয়

এই নীতিগুলো বুঝতে পারলে আমরা খাদ্য নিয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে সুস্থতার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব। তাই আয়ুর্বেদ ও প্রকৃতিশাস্ত্রের জ্ঞান গ্রহণ করে এমন খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন, যা শরীরকে পুষ্টি দেয় এবং সামগ্রিক সুস্থতা নিশ্চিত করে।

সঠিক খাদ্যাভ্যাস শুধু আমাদের শরীরকে পুষ্টি দেয় না, বরং সামগ্রিক সুস্থতা ও ভারসাম্য বজায় রাখতেও সাহায্য করে। একটি সুস্থ, ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিজের শরীরের কথা ভেবে খাদ্য নির্বাচন করুন, সুস্থ থাকুন!