রাধা—এই নামটি ভক্তদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়, কারণ তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন সর্বোচ্চ রূপের দিব্য প্রেমকে। কিন্তু রাধা আসলে কে? তিনি কি কেবল এক দেবী, ভক্তির প্রতীকমাত্র? নাকি তাঁর অস্তিত্ব আরও গভীর ও মহৎ? হতে পারে, তিনিই সেই গোপন রহস্যের কেন্দ্র—আদিশক্তি, মূল মহাশক্তি, যাঁর অন্তর থেকে সমগ্র সৃষ্টির প্রথম স্পন্দন জেগে উঠেছিল। কারও কাছে তিনি হলেন দিব্য প্রেমের পরম প্রকাশ, আবার কারও মতে তিনি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের আনন্দময় শক্তি—হ্লাদিনী শক্তির মূর্ত প্রতীক। তাঁর পরিচয় ঘিরে থাকা রহস্য এবং শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অপার গভীরতা যুগে যুগে মানুষকে বিস্ময় এবং ভক্তিতে আপ্লুত করেছে।
সৃষ্টি-লীলার সূক্ষ্ম নৃত্যে, রাধা ও কৃষ্ণ কি সত্যিই আলাদা? নাকি তাঁরা একই দিব্য সত্তার দুই দিক—অভিন্ন, অথচ আলাদা রূপে প্রকাশিত, যেন প্রেম ও আনন্দ আরও গভীরভাবে অনুভূত হয়?
জগদগুরু শ্রী কৃপালুজী মহারাজ তাঁর গ্রন্থ 'ভক্তি শতক'-এ লিখেছেন:
अद्वितीय इक तत्व है, राधा तत्व प्रधान।
याको दूजो रूप है, स्वयं कृष्ण भगवान।।
অদ্বিতীয় ইক তত্ত্ব হেই, রাধা তত্ত্ব প্রধান ।
যাকো দুজো রূপ হেই, স্বয়ং কৃষ্ণ ভগবান ।।
অর্থ: সমগ্র সৃষ্টির অন্তরালে বিরাজমান একমাত্র পরম তত্ত্ব হলেন শ্রীরাধা। পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ হলেন সেই শ্রীরাধারই অবিচ্ছেদ্য এবং অভিন্ন রূপ।
जोइ राधा सोइ कृष्ण हैं, इन में भेद न मान।
इक हैं ह्लादिनी शक्ति अरु, शक्तिमान इक जान।।
জোই রাধা সোই কৃষ্ণ হেই, ইন মে ভেদ ন মান ।
ইক হেই হ্লাদিনী শক্তি অরু, শক্তিমান ইক যান ।।
অর্থ: শ্রীকৃষ্ণ হলেন শ্রীরাধার অবিচ্ছেদ্য অপর রূপ, এবং শ্রীরাধা হলেন শ্রীকৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য অপর রূপ। শ্রীরাধা হলেন হ্লাদিনী শক্তি, আর শ্রীকৃষ্ণ হলেন সেই শক্তির আধার—শক্তিমান।
হ্লাদিনী শক্তির উপলব্ধি: ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আনন্দদায়িনী শক্তি
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অসীম শক্তির অধিকারী, এই শক্তিগুলি বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড শ্রীকৃষ্ণের মায়া শক্তি (ভৌতিক শক্তি) থেকে উদ্ভূত, অপরিমেয় জীবাত্মাদের উদ্ভব হয়েছে জীব শক্তি (আত্মিক শক্তি) থেকে। বৈকুণ্ঠ সহ যাবতীয় দিব্য ধামগুলি চিৎ শক্তি (চৈতন্য শক্তি) থেকে প্রকাশিত। মায়া শক্তি যেখানে জড় ও নিস্প্রাণ, সেখানে চিৎ শক্তি হল সচেতন ও কার্যকরী এক সত্তা।
এই চিৎ শক্তিকে, স্বরূপ শক্তি নামেও অভিহিত করা হয়, এবং একে যোগমায়া শক্তিও বলা হয়—এটি এমন এক শক্তি যা সম্ভব-অসম্ভব সবকিছুই সাধন করতে সক্ষম। যেহেতু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং সচ্চিদানন্দ— চিরন্তন অস্তিত্ব (সৎ), চৈতন্য (চিৎ) ও আনন্দ (আনন্দ)-এর মূর্ত প্রতীক, তাই স্বরূপ শক্তি প্রধানত তিনটি রূপে প্রকাশ পায়:
- সন্ধিনী শক্তি (চিরন্তন অস্তিত্ব): স্বরূপ শক্তির এই অংশ ভগবানের চিরন্তন অস্তিত্বকে ধারণ করে। এই শক্তির দ্বারাই শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত জগতে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখেন।
- সম্বিত শক্তি (দিব্য জ্ঞান): এই শক্তি ভগবানের সর্বজ্ঞতা ও দিব্য জ্ঞানপ্রদানের মূল কারণ। সম্বিত শক্তির মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দিব্য জগতে যা কিছু আছে, তা সমস্তই জানেন।
- হ্লাদিনী শক্তি (আনন্দ): এই শক্তি ভগবানের দিব্য আনন্দ দানকারী শক্তি। হ্লাদিনী শক্তির মাধ্যমেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে সর্বদা পরমানন্দে অবস্থান করেন এবং তাঁর ভক্তদেরও সেই দিব্য আনন্দে আপ্লুত করেন।
সন্ধিনী শক্তি শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ব বা 'সৎ'-তত্ত্বকে রক্ষা করে, সম্বিত শক্তি তাঁর সর্বজ্ঞতা বা 'চিৎ'-তত্ত্বকে নিশ্চিত করে এবং হ্লাদিনী শক্তি তাঁর চিরন্তন আনন্দ বা 'আনন্দ'-তত্ত্বের প্রকাশ ঘটায়। উপরন্তু, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই শক্তিগুলিকে শুধু নিজের দিব্য স্বরূপ রক্ষা করতেই নয়, বরং তাঁর ভক্তদের রক্ষা করতে এবং তাঁদের জ্ঞান ও আনন্দ প্রদান করতেও ব্যবহার করেন।
এইভাবে, শ্রীরাধা হলেন হ্লাদিনী শক্তির মূর্ত প্রতীক, আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন এই শক্তির ধারক বা অধিকারী। ফলে, তাঁদের মধ্যে কোনও ভেদ বা বিচ্ছেদ নেই। যেমন দুধ থেকে সাদা রং, কিংবা চাঁদের থেকে চাঁদের আলো আলাদা করা যায় না, তেমনি রাধা ও কৃষ্ণ স্বরূপতঃ অভিন্ন। তবে, দিব্য লীলার ক্ষেত্রে—তাঁরা পৃথক পৃথক, রাধা ও কৃষ্ণ রূপে প্রকট হন।
যদি তাঁরা অভিন্ন হন, তবে কেন পৃথক রূপ ধারণ করেন? এই গভীর সত্যটি উপলব্ধি করার জন্য চলুন, শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের এক মধুর লীলাকথা আস্বাদন করি।
যদি তাঁরা অভিন্ন হন, তবে কেন পৃথক রূপ ধারণ করেন? এই গভীর সত্যটি উপলব্ধি করার জন্য চলুন, শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের এক মধুর লীলাকথা আস্বাদন করি।
একই দিব্য সত্তা, যার দুই রূপ: রাধা ও কৃষ্ণের অনন্ত মাধুর্য
এক শান্ত, নিবিড় কুঞ্জবনে, নিকুঞ্জে, শ্রীমতী রাধারানী গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তাঁর হৃদয় পরিপূর্ণ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নিঃস্বার্থ প্রেম ও ভক্তিতে। শ্রীকৃষ্ণ, যিনি চিরকাল লীলাময় ও মোহনরূপ, রাধার রাধার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যখন রাধার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকান, তখন এক অভাবনীয় দৃশ্য ঘটে—রাধার দেহের প্রতিটি রন্ধ্র থেকে উচ্চারিত হতে থাকে "শ্যাম শ্যাম", শ্রীকৃষ্ণের নাম, যা রাধারানির শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমের গভীরতা ও উচ্ছ্বাসকে প্রকাশ করে।
রাধার এই সীমাহীন প্রেমে অভিভূত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে ভাবেন, “রাধার প্রেম তো অপার! এই প্রেমের তুলনা নেই!” এই উপলব্ধিতে তিনি এত আনন্দে ভরে যান যে মুহূর্তের মধ্যেই বিহ্বল হয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়েন। রাধারানি যখন নিদ্রা থেকে ওঠেন এবং নিজের পাশে শ্রীকৃষ্ণকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পান, তখন আর একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে—শ্রীকৃষ্ণের প্রতিটি রন্ধ্র থেকে ধ্বনিত হতে থাকে "রাধে রাধে", রাধার নাম।
সেই পবিত্র মুহূর্তে রাধার হৃদয় প্রেমে উথলে ওঠে। তিনি ধীরে ধীরে নিজেই বলেন, “কৃষ্ণ আমায় এত গভীর প্রেম করেন—আমি তো কখনও বুঝতেই পারিনি!” এই উপলব্ধির প্রাচুর্যে তিনিও প্রেমাবিষ্ট হয়ে দুলে ওঠেন এবং তাঁদের চিরন্তন মিলনের অপরিসীম সুখে বিলীন হয়ে এক অদ্ভুত আনন্দে মূর্ছিত হয়ে পড়েন।
তাঁদের দিব্য প্রেম এক অপূর্ব প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে—এ এক অনন্ত পরস্পরভক্তির চক্র। জ্ঞান ফেরার পর শ্রীকৃষ্ণ দেখেন, রাধার অধরে তখনও কৃষ্ণের মধুর নাম প্রতিধ্বনিত হচ্ছে; সেই দৃশ্যে দেখে তিনি আবার প্রেমে আপ্লুত হয়ে অচেতন হয়ে পড়েন। রাধারানির জ্ঞান ফিরলে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে একইভাবে দেখে পুনরায় প্রেমাবিষ্ট হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এটি এক দিব্য লীলা— লুকোচুরির মতো, তবে দুর্বলতা থেকে নয়, বরং তাঁদের প্রেমের অসীম আনন্দ, 'প্রেম রস'-এর উচ্ছ্বাস থেকে। এই প্রেমরস আস্বাদন ও উপভোগের উদ্দেশ্য ও ভক্তদের এই প্রেম রস এ আপ্লুত করার জন্যই পরমেশ্বর স্বয়ং দুই রূপে—রাধা ও কৃষ্ণ হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন।
রাধা-কৃষ্ণের দিব্য লীলা: মিলন ও বিরহের মাধ্যমে প্রেমের বৃদ্ধি
হ্লাদিনী শক্তির প্রতিমূর্তি শ্রীমতী রাধারানী কখনও কখনও এমন কিছু লীলায় প্রবেশ করেন, যেখানে তিনি অভিমান বা কৃত্রিম রাগ প্রকাশ করেন। এই অভিমান আসলে কোনও বাস্তব অসন্তোষ নয়, বরং এক দিব্য কৌশল—যার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রেমের আরও গভীর আনন্দ অনুভব করেন।
তাঁদের দিব্য লীলায় প্রায়ই শ্রীকৃষ্ণকে দেখা যায় রাধারানির পায়ে আশ্রিত অবস্থায়, কাতরভাবে তাঁর কৃপা প্রার্থনা করছেন। এই দৃশ্যটি অনুপমভাবে রাধার উচ্চতর অবস্থানকে প্রকাশ করে—তিনি শ্রীকৃষ্ণের স্বামিনী, এবং সেই অপরিহার্য শক্তি, যাঁর অনুগ্রহ ছাড়া শ্রীকৃষ্ণ, যিনি শক্তির আধার, নিজের দিব্য আনন্দও পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। রাধার পরম ভূমিকা ও শ্রীকৃষ্ণের আত্মিক আনন্দের এই গূঢ় সত্যকেই বহন করে সেই জনপ্রিয় ভক্তিসঙ্গীতের পংক্তি — “রাধে রাধে বোল, শ্যাম ভাজে চলে আয়েংগে” । অর্থাৎ – রাধে রাধে বল, শ্যাম দৌড়িয়ে চলে আসবেন।
ভৌতিক জগতে, দীর্ঘ বিরহের পর প্রেমিক-প্রেমিকার পুনর্মিলনের আনন্দ সবসময়ই তাদের দৈনন্দিন সাক্ষাতের চেয়ে গভীরতর ও মধুরতর হয়। তেমনি দিব্য জগতে, রাধা ও কৃষ্ণের লীলা—যেখানে মিলন ও বিরহ পর্যায়ক্রমে ঘটতে থাকে—তাঁদের প্রেম ও আনন্দের রসকে আরও গভীর, আরও অপার করে তোলে। এই লীলা সাধারণ বুদ্ধি বা যুক্তির অতীত, কারণ এখানে বিচ্ছেদ ও মিলন—উভয়ই সেই চিরন্তন প্রেমরসকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করার উপায়।
অবশেষে, রাধা ও কৃষ্ণের এইসব দিব্য লীলাগুলি প্রকাশ করে যে পরম সত্যের দৃষ্টিতে তাঁদের মধ্যে কোনও প্রকৃত বিচ্ছেদ নেই। যে বিচ্ছেদ আমরা বাহ্যিকভাবে দেখি, তা প্রকৃতপক্ষে এক লীলা—যার মাধ্যমে তাঁদের চিরন্তন ঐক্য ও প্রেম আরও গভীরভাবে প্রকাশ পায়। এই দিব্য লীলার মধ্য দিয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় সেই অপার প্রেমের গভীরে প্রবেশ করতে, যেখানে রাধা ও কৃষ্ণের চিরন্তন মিলনের অসীম আনন্দ সর্বোচ্চ মহিমায় উদ্ভাসিত হয়।