কলিযুগের অন্ধকার ও নৈতিক অবক্ষয়ের মধ্যেও ঈশ্বর প্রাপ্তির সবচেয়ে সহজ পথ হলো তাঁর নাম জপ করা। এই বিশ্বাস ভগবান রাম ও ভগবান কৃষ্ণের লীলায় প্রতিফলিত হয়, যেখানে তাঁরা মানব রূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে ভক্তদের সঠিক পথ দেখান ও অনুপ্রাণিত করেন।
नहिं कलि करम न भगति बिबेकू । राम नाम अवलंबन एकू ।।
कालनेमि कलि कपट निधानू । नाम सुमति समरथ हनुमानू ।।
নাহিঁ কলি করম ন ভগতি বিবেকূ । রাম নাম অবলম্বন একূ।।
কালনেমি কলি কপট নিধানূ। নাম সুমতি সমরথ হনুমানূ।।
অর্থ: কলিযুগে কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান—কোনো কিছুই কার্যকর নয়; শুধুমাত্র শ্রীরামের নামই একমাত্র আশ্রয়। কলিযুগকে কল্পনা করা যায় কালনেমি রাক্ষসের মতো, যে প্রতারণার এক বিশাল ভাণ্ডার; আর শ্রীরামের নাম হলো হনুমানের মত। যেমন হনুমানজি শ্রীরামের নাম জপ করে কালনেমিকে পরাস্ত করেছিলেন, তেমনি আমরাও কলিযুগের ছলনা ও প্রলোভন অতিক্রম করতে পারি ভগবান রামের নাম স্মরণ করেই।
বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী, ঈশ্বর, যিনি ব্রহ্ম বা পরব্রহ্ম নামে পরিচিত, তিনি অজাত (যিনি জন্ম নেন না), সর্বব্যাপী (সর্বত্র বিদ্যমান) এবং অগোচর (যিনি ইন্দ্রিয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে)। কিন্তু সেই একই ব্রহ্ম, ভক্তদের কল্যাণের জন্য মানব রূপ ধারণ করেন, যেমন শ্রীরাম বা শ্রীকৃষ্ণ, এবং মানুষের মতো লীলা করেন। যদিও তিনি মানব রূপ ধারণ করেন, তথাপি তাঁর নিরাকার ও সাকার রূপের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তিনি মায়ার অতীত, জড় জগতের মোহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না, এমনকি মানব রূপেও।
তবে যখন ঈশ্বর মানব রূপে অবতীর্ণ হন, তখন তিনি তাঁর ভক্তদের প্রেমে আবিষ্ট হয়ে স্বয়ং নিজের ঈশ্বরত্ব ভুলে যান। এই অনন্য প্রেমলীলা শ্রীরাম ও শ্রীকৃষ্ণের জীবনে লক্ষ্য করা যায়, যেখানে ঈশ্বর নিজে ভক্তদের প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকেন।
সতীর সন্দেহ ও ভগবান রামের পরিচয়ের পরীক্ষা
মাতা সীতার বিরহে ব্যাকুল শ্রীরামকে মানবীয় অনুভূতি প্রকাশ করতে দেখে সতীর মনে সন্দেহ জাগ্রত হয়। তিনি ভাবতে লাগলেন— "ইনিই কি সেই রাম, যাঁকে আমার স্বামী মহাদেব সদা সমাধিস্থ হয়ে পূজা করেন?" তিনি বিস্ময়ে বলেন:
ब्रह्म जो ब्यापक बिरज अज अकल अनीह अभेद ।
सो कि देह धरि होइ नर जाहि न जानत बेद ।।
ব্রহ্ম জো ব্যাপক বিরজ অজ অকল অনীহ অভেদ।
সো কি দেহ ধরি হোই নর জাহি ন জানত বেদ।।
অনুবাদ: "ব্রহ্ম, যিনি সর্বব্যাপী, অজাত (জন্ম নেই যার), পূর্ণ, আকাঙ্ক্ষাহীন, মায়ার অতীত এবং সকল প্রকার বিভেদের ঊর্ধ্বে, যাঁর প্রকৃত পরিচয় দিতে বেদও অক্ষম—তিনি কি মানুষের রূপ ধারণ করতে পারেন?"
সতী মাতৃসীতার রূপ ধারণ করে ভগবান রামকে পরীক্ষা করতে যান। কিন্তু শ্রীরাম তাঁকে অবিলম্বে চিনতে পারেন এবং বলেন, "হে মা! আপনি এখানে গভীর অরণ্যে একা কী করছেন? আমার পিতা মহাদেব কোথায়?" সতী এই কথা শুনে লজ্জিত হয়ে মহাদেবের কাছে ফিরে যান।
শ্রীকৃষ্ণের লীলায় ব্রহ্মার বিভ্রম
শ্রীকৃষ্ণের ব্রহ্মা-বিমোহন লীলা এই সত্যকে আরও স্পষ্ট করে। কৃষ্ণকে তাঁর রাখাল বন্ধুদের (গোয়াল বালক সখা) সঙ্গে গভীর সখ্যতায় মগ্ন দেখে ব্রহ্মার মনে সন্দেহ জেগে ওঠে। তিনি কৃষ্ণকে পরীক্ষা করতে গোপাল বন্ধুদের লুকিয়ে ফেলেন। কিন্তু এক বছর পর ফিরে এসে ব্রহ্মা দেখলেন, কৃষ্ণ তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ঠিক একইভাবে রয়েছেন—তিনি স্বয়ং সেই নিখোঁজ বন্ধুদের রূপ ধারণ করে তাঁদের সাথে লীলায় মগ্ন। এ দৃশ্য দেখে ব্রহ্মা অভিভূত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের চরণে লুটিয়ে পড়েন এবং তাঁর মহিমা কীর্তন করেন।
अस्यापि देव वपुषो मदनुग्रहस्य
स्वेच्छामयस्य न तु भूतमयस्य कोऽपि ।
অস্যাপি দেব বপুষো মদনুগ্রহস্য
স্বেচ্ছাময়স্য ন তু ভূতময়স্য কোপি।
(ভাগবতম ১০.১৪.২)
অনুবাদ: "হে প্রভু, আপনার দেহ পঞ্চ মহাভূত (পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ) দ্বারা গঠিত নয়; এটি সম্পূর্ণরূপে দিব্য। এবং আপনি স্বেচ্ছায় এই রূপ ধারণ করেছেন, আমাদের মতো জীবাত্মাদের প্রতি কৃপা বর্ষণ করার জন্য।"
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (৯.১১)-তে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন:
अवजानन्ति मां मूढा मानुषीं तनुमाश्रितम् ।
परं भावमजानन्तो मम भूतमहेश्वरम् ।।
অবজানন্তি মাম মূঢ়া মানুষীম তনুমাশ্রিতাম।
পরম ভাবম-অজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম।।
অনুবাদ: "যখন আমি মানবরূপে অবতীর্ণ হই, মোহগ্রস্ত ব্যক্তিরা আমাকে চিনতে সক্ষম হয় না। তারা আমার এই দিব্য স্বরূপকে সমগ্র সৃষ্টির পরমেশ্বর রূপে উপলব্ধি করতে পারে না।”
ভগবান রামের দিব্য লীলা ও অবতারের উদ্দেশ্য
এই দিব্য লীলা শুধুমাত্র সাধারণ কাহিনী নয়; বরং এগুলোর গভীর তাৎপর্য রয়েছে। দেবী পার্বতীর সামনে রামচরিতমানস বর্ণনা করতে গিয়ে ভগবান শিব ব্যাখ্যা করেন যে, ভগবান রামের প্রতিটি অবতার অনন্য, এবং প্রতিটি অবতারের স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য ও লীলা আছে।তবে প্রতিটি অবতারের একটি উদ্দেশ্য সবসময়ই প্রযোজ্য—ভক্তদের প্রতি তাঁর কৃপা বর্ষণ করা। তিনি তাঁর নাম, রূপ, গুণ ও ধাম প্রদান করেন, যা ভক্তদের পরম মোক্ষের দিকে নিয়ে যায়। এই লীলার মাধ্যমে ভক্তদের ভবসাগর (জাগতিক বন্ধনের মহাসমুদ্র) অতিক্রম করে আত্মার মুক্তি অর্জনের পথ দেখানো হয়।
सोइ जस गाइ भगत भव तरहीं । कृपासिंधु जन हित तनु धरहीं ।।
राम जनम के हेतु अनेका । परम बिचित्र एक तें एका ।।
সোই জস গাই ভগত ভব তরহীঁ । কৃপাসিন্ধু জন হিত তনু ধরহীঁ ।।
রাম জনম কে হেতু অনেকা । পরম বিচিত্র এক তে একা ।।
অনুবাদ: "ভক্তরা ভগবানের মহিমা কীর্তন করে এই সাগররূপী সংসার পার হন। পরম করুণাময় ঈশ্বর ভক্তদের কল্যাণের জন্য মানব দেহ ধারণ করেন। শ্রীরামচন্দ্রজীর জন্মের বহু কারণ রয়েছে; প্রতিটি কারণই বিচিত্র।"
মহাদেব মাতা পার্বতীকে বলেন:
एहि बिधि जनम करम हरि केरे । सुंदर सुखद बिचित्र घनेरे ।।
कलप कलप प्रति प्रभु अवतरहीं । चारु चरित नानाबिधि करहीं ।।
এহি বিধি জনম করম হরি কেরে । সুন্দর সুখদ বিচিত্র ঘনেরে ।।
কলপ কলপ প্রতি প্রভু অবতরহীঁ ।। চারু চরিত নানাবিধি করহীঁ ।।
অনুবাদ: "এইভাবে শ্রীরাম অসংখ্যবার জন্মগ্রহণ করে বহু মনোরম, আনন্দময় ও অতুলনীয় লীলা প্রদর্শন করেছেন। ভগবান যখনই প্রতিটি যুগে অবতীর্ণ হন, তিনি নানান সুন্দর লীলার প্রকাশ করেন।"
মহাদেব বারবার জোর দিয়ে বলেন যে, শ্রীরাম ভক্তদের কল্যাণের জন্যই ধরাধামে আগমন করেন। তিনি এভাবেই ইতি টানেন:
हरि अनंत हरिकथा अनंता । कहहिं सुनहिं बहुबिधि सब संता ।।
रामचंद्र के चरित सुहाए । कलप कोटि लगि जाहिं न गाए ।।
হরি অনন্ত হরিকথা অনন্তা । কহহিঁ সুনহিঁ বহুবিধি সব সন্তা ।।
রামচন্দ্র কে চরিত সুহায়ে । কলপ কোটি লগি জাহিঁ ন গায়ে ।।
অনুবাদ: "হরি অনন্ত (তাঁর কোন আদি-অন্ত নেই), এবং তাঁর লীলাকাহিনীও অসীম; সকল সাধু বিভিন্নভাবে তাঁকে বর্ণনা করেন ও শ্রবণ করেন। কোটি কোটি যুগ ধরে বিবরণ দিলেও শ্রীরামচন্দ্রের চিত্তাকর্ষক চরিত্র সম্পূর্ণ ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।”
ভক্তির মাধ্যমে শ্রীরামের সঙ্গে অটল সংযোগ স্থাপন
তাহলে, আমাদের জন্য সর্বোত্তম পথ কী?
ভগবানের দিব্য লীলামৃত আস্বাদন করা, তাঁর নাম জপ করা, তাঁর অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া এবং সম্পূর্ণভাবে তাঁর প্রেমে নিমগ্ন হওয়া। আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় কান কীরকম হওয়া উচিত – সে বিষয়ে সন্ত তুলসীদাস বলেন:
जिन्ह के श्रवन समुद्र समाना। कथा तुम्हारि सुभग सरि नाना॥
জিহ্ন কে শ্রবণ সমুদ্র সমানা । কথা তুম্হারি সুভগ সরি নানা ।।
অনুবাদ: "সমুদ্রে বহু নদী মিলিত হওয়ার পরেও যেমন সমুদ্র কখনও সম্পৃক্ত হয় না; ঠিক তেমনই তোমার (রামের) অসংখ্য মনোহর লীলা শ্রবণ করেও যাঁরা কখনো সম্পূর্ণ তৃপ্ত হয় না – এমন বিশাল সমুদ্রের মতই তাঁদের কান।"
ভক্ত হিসেবে আমাদের জন্য শ্রীরামের সঙ্গে গভীরতর সংযোগ স্থাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সব ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সদা তাঁর কৃপা গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত এবং কখনোই আত্মতুষ্ট হওয়া উচিত নয়। আমাদের কান যেন সদা তাঁর আকর্ষণীয় লীলাকথা শ্রবণ করে এবং আমাদের চক্ষু যেন তাঁর দিব্য রূপের সৌন্দর্যের জন্য চিরতৃষিত থাকে। এমন আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে আমরা আমাদের ভক্তিকে আরও গভীর করতে পারি এবং শ্রীরামের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে দৃঢ়তর করে তুলতে পারি।
শুভ রামনবমী উদ্যাপন করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরামের নাম, রূপ, গুণ, লীলা ও ধাম সম্পর্কে আমাদের গভীরভাবে চিন্তন ও মনন করা অত্যন্ত জরুরী। তাঁর দিব্য রূপ ও গুণাবলীর ধ্যান করে, তাঁর কৃপা ও প্রেম প্রার্থনা করে, ভক্তেরা কলিযুগের নানা বাধাবিপত্তিকে দৃঢ়চিত্তে অতিক্রম করতে পারেন এবং ধাপে ধাপে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পথে এগিয়ে যেতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায়, অটল ভক্তি ও ঈশ্বরস্মরণের মাধ্যমে যে কেউ এই জড় জগতের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে পরমাত্মার সঙ্গে মিলনে উপনীত হতে পারে। এই আধ্যাত্মিক যাত্রা চূড়ান্ত আনন্দ ও শাশ্বত সুখের দিকে নিয়ে যায়, যা প্রতিটি আত্মার পরম লক্ষ্য।