প্রতি বছর শারদ পূর্ণিমার দিনে ভারতবর্ষসহ বিভিন্ন দেশে জগদগুরু শ্রী কৃপালুজী মহারাজের জন্মদিন (জগদগুরুত্তম জয়ন্তী) ভক্তিভরে পালিত হয়। মহারাজজীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২০২২ সালে উড়িষ্যার বানারায় পবিত্র জেকেযোগ ভক্তি আশ্রমে অনুষ্ঠিত চারদিনব্যাপী শিবির ছিল এক অনন্য আধ্যাত্মিক উৎসব, যেখানে পরিব্যাপ্ত ছিল প্রেম, ভক্তি ও জ্ঞান। এই মহামিলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত ছিল জগদগুরুর আরতি সংগীতের গভীর ব্যাখ্যা, যা প্রদান করেন স্বামী মুকুন্দানন্দ। শ্রী কৃপালুজী মহারাজের শিক্ষায় গতানুগতিক বাহ্যিক আচার-আচরণের পরিবর্তে চিরকালই “রূপ-ধ্যান” প্রাধান্য পেয়েছে – অর্থাৎ ঈশ্বর ও গুরুর নাম, রূপ, গুণ, ধাম ও লীলার স্মরণ। মহারাজজীর সেই শিক্ষার মর্যাদা দিতেই তাঁর আরতি সঙ্গীতের বিশদ বিবরণ দেন স্বামীজী – যাতে আমরা প্রতিটি পংক্তির অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারি।
আমাদের প্রিয় গুরুদেবের রূপ-ধ্যান ও আমাদের সাধনার উন্নতির জন্যই সমস্ত ভক্তদের প্রতি এই আরতি সঙ্গীত অনুবাদটি উপহারস্বরূপ। এবার জগদগুরু আরতির প্রথম স্তবকটির অর্থ আত্মস্থ করে নেওয়া যাক যাতে প্রতিদিন গানটি গাওয়ার সময় সেই ভাব আমাদের অন্তরে প্রকাশ পায়।
প্রণতি-জ্ঞাপনার্থে ভক্তবৃন্দকে আহ্বান
এই আরতিতে শ্রী গুরুদেবের পাদপদ্মে বিনীত প্রণাম জানানোর জন্য ভক্তদের আহ্বান জানানো হয়েছে। গুরুদেবের প্রতি ভক্তিপূর্ণ প্রথম স্তবকটি হলঃ
जयति जगद्गुरु गुरुवर की, गावो मिली आरती रसिकवर की |
गुरुपद-नख-मणि-चन्द्रिका प्रकाश, जाके उर बसे ताके मोह तम नाश |
जाके माथ नाथ तव हाथ कर वास, ताते होय माया मोह सब ही निरास |
पावे गति मति रति राधावर की, गावो मिली आरती रसिकवर की।।
জয়তি জগদগুরু গুরুবর কী, গাভো মিলি আরতি রসিকবর কী।
গুরুপদ-নখ-মণি-চন্দ্রিকা প্রকাশ, জাকে উর বসে তাকে মোহ তম নাশ।
জাকে মাথ নাথ তব হাত কর বাস, তাতে হোয় মায়া মোহ সব হী নিরাস।
পাবে গতি মতি রতি রাধাবর কী, গাভো মিলি আরতি রসিকবর কী।।
অনুবাদঃ আমার গুরুদেবের চরণকমল থেকে নির্গত দিব্য দ্যুতি সেই সমস্ত মানুষের হৃদয় থেকে অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করে দেয় যারা গভীর ভালবাসার সঙ্গে ওই চরণযুগলের উপাসনা করে। আমার প্রিয় গুরুবরের প্রেম, কৃপা ও আশ্রয় যারা লাভ করেছে, মায়ার ভ্রান্তি অথবা মায়ার যাবতীয় সাঙ্গোপাঙ্গরা (ক্রোধ, লোভ, ঘৃণা, ঈর্ষা প্রভৃতি) তাদের কোনভাবেই প্রভাবিত করতে পারে না। এমন দুর্লভ আশীর্বাদধন্য পরম ভাগ্যবান ভক্তদেরই শ্রীকৃষ্ণের ধাম, জ্ঞান ও প্রেম প্রাপ্তি ঘটে।
ভগবদ্প্রাপ্তির গুহ্য জ্ঞানই সরল ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে উপরোক্ত পংক্তিগুলিতে – যা কিনা ভক্তিভাবের সঙ্গে যে কোন শিশুও মনে রাখতে পারবে। সকল রসিক সন্তের মুকুটমণি আমাদের অত্যন্ত প্রিয় জগদগুরুকে মহিমান্বিত করা হয়েছে এই সঙ্গীতের মাধ্যমে। তিনি যে কেবল পঞ্চম মূল জগদগুরু রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তা-ই নয়; তিনি জগদগুরুত্তম – অর্থাৎ অন্য সকল জগদগুরুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। কাশী বিদ্যা পরিষদ, বৈদিক সাহিত্যের 500 পণ্ডিতদের একটি অভিজাত সংস্থা মহারাজজিকে এই উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
শ্রী কৃপালুজী মহারাজের অদ্বিতীয় দর্শন
জগদগুরু শ্রী কৃপালুজী মহারাজজী যে অভিনব সিদ্ধান্ত (দার্শনিক দৃষ্টিকোণ) উপস্থাপিত করেছেন – তা যেমন স্বচ্ছ, তেমনই কাব্যিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। তিনি ঈশ্বর ও গুরুর প্রতি নিষ্কাম ও অনন্য ভক্তির পথ দেখিয়েছেন। মহারাজজীর শিক্ষা তাঁর অনুগামীদের হৃদয়ে ও মনে গেঁথে আছে।
মহারাজজী শিখিয়েছেন যে মানব জীবনের প্রধান লক্ষ্য হল ভগবদ্-প্রাপ্তি; কারণ মানুষ মাত্রেই আনন্দের অভিলাষ রাখে এবং ঈশ্বরই আনন্দের মূল উৎস। অথচ, আমাদের জাগতিক ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি দিয়ে ভগবানকে অনুভব করা যায় না। এখানেই গুরুর ভূমিকা অপরিসীম। গুরু আমাদের আন্তরিক অজ্ঞতা দূর করে ভগবানের পথে চলার জ্ঞান প্রদান করেন। জ্ঞানলাভের ফলে বিশ্বাস জন্মায়; আর ভালবাসা থেকে আসে ভালবাসা।
গুরুর দিব্যত্ব
গুরুদেবের চরণকমলের নখ থেকে নির্গত দিব্য আলো (গুরুপদ-নখ-মণি-চন্দ্রিকা প্রকাশ) গাঢ় অন্ধকার রাত্রির আকাশে স্থিত চন্দ্রমার রশ্মির মত; যা মায়ার আঁধার দূর করে। গুরু তাঁর হাত আমাদের মস্তকে স্থাপন করলে (জাকে মাথ নাথ তব হাত কর বাস) মায়ার বিভ্রান্তি বিলুপ্ত হয়; তারপর সেই জীবাত্মা সঠিক পথ দেখতে পেয়ে (গতি) নিজের মন-বুদ্ধিকে গুরু তথা ঈশ্বরের প্রতি শরণাগত (মতি) করে ভগবানের প্রতি আকৃষ্ট (রতি) হয়।
গুরুর সাহায্যে ঐশ্বরিক পথে অনুগমন
এই পংক্তিগুলিতে "চন্দ্রিকা প্রকাশ" শব্দবন্ধ দ্বারা বোঝানো হয়েছে শারদ পূর্ণিমার সেই আলোকোজ্জ্বল রাত্রি, যেদিন চন্দ্র নিজ দীপ্তির সর্বোচ্চ রূপে প্রকাশিত হন। এর মাধ্যমে মহারাজজীর এই পৃথিবীতে অবতরণের দিনটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বিগত ৫০০০ বৎসরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জগদগুরু শ্রী কৃপালুজী মহারাজের মহিমা ব্যক্ত করা হয়েছে এই স্তবকে।
অনুগ্রহ করে অন্যান্য পংক্তির ব্যাখ্যার জন্য পরবর্তী নিবন্ধের প্রতীক্ষা করুন।