তুলাসীদাস রচিত ‘রামচরিত-মানস’ এ, ভগবান শিব দেবী পার্বতীকে বলেন যে, বিভিন্ন কারণে পরমেশ্বর ভগবান অবতার গ্রহণ করেন এবং পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনা যে কী কারণে ভগবান অবতার গ্রহণ করেন।
সুনু গিরিজা হরিচরিত সুহায়ে। বিপুলা বিসদা নিগমাগমা গায়ে।।
হরি অবতার হেতু যেহি হই। ইদমিত্থং কহি যাই না সই।।
sunu girijā haricarita suhā'e. bipula bisada nigamāgama gā'e
hari avatāra hetu jehi ho'ī. idamitthaṁ kahi jā'i na so'ī
“শোনো হে পার্বতী! বেদ ও বিভিন্ন শাস্ত্রে শ্রীহরির বিশুদ্ধ ও সুন্দর চরিত্র বিশদে গাওয়া হয়েছে। কোনো একটা নির্দিষ্ট কারণে হরি অবতার রূপ ধারণ করেছেন এমনটা বলা সম্ভব নয় যেহেতু, এমন অনেক কারণ থাকতে পারে যেগুলো আমাদের বস্তুগত বুদ্ধির বোধগম্যতার অতীত।”
দুষ্টের দমন ও ভক্তগণের পালন করে ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং ভগবানের মহিমা প্রচার করাই হলো ভগবানের অবতার গ্রহণের মূল কারণ। ভগবান শিব তখন বিভিন্ন কল্পে ভগবান রাম ও রাবনের বিভিন্ন অবতার কাহিনী বর্ণনা করেন। এখানে, আমরা সেই গল্পগুলো জানবো।
দুষ্টের দমন ও ভক্তগণের পালন করে ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং ভগবানের মহিমা প্রচার করাই হলো ভগবানের অবতার গ্রহণের মূল কারণ। ভগবান শিব তখন বিভিন্ন কল্পে ভগবান রাম ও রাবনের বিভিন্ন অবতার কাহিনী বর্ণনা করেন। এখানে, আমরা সেই গল্পগুলো জানবো।
শাপ-প্রাপ্তি এবং শাপমোচনের চক্র : জয় ও বিজয়ের বৈকুণ্ঠ থেকে পৃথিবীতে যাত্রা
একবার চারকুমারগণ (সনক, সানন্দন, সনাতন, সনৎকুমার), ভগবান বিষ্ণুর ধাম বৈকুণ্ঠে যান তাঁর দর্শন লাভের উদ্দেশ্যে। তখন জয় ও বিজয় নামে প্রভুর দুই প্রহরী তাঁদের ভেতরে যেতে বাধা দেয়। এর ফলে তাঁদের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝি ঘটে এবং অবশেষে চারকুমারগণ, জয় ও বিজয়কে পৃথিবীতে তিন জীবন ধরে রাক্ষস রূপে জন্ম নেওয়ার অভিশাপ দেন। এই অভিশাপের ফলে জয় ও বিজয় যথাক্রমে হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু রূপে জন্ম নিয়ে তাদের জীবিত সময়কালে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও ধ্বংসাত্মক কর্মে লিপ্ত হয়। শান্তি পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে ভগবান বিষ্ণুকে যথাক্রমে বরাহ ও নরসিংহের অবতার গ্রহণ করে রাক্ষসদের পরাজিত করতে হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়; জয় ও বিজয় যথাক্রমে রাবণ ও কুম্ভকর্ণ রূপে এই নশ্বর পৃথিবীতে ফিরে আসেন। ঐ সময় ভগবান রাম আবির্ভূত হন এবং তিনি ঐ দুজনকে পরাজিত করেন।
ঋষি নারদের অভিশাপ এবং রাবণ ও কুম্ভকর্ণের জন্ম-কাহিনী
একবার নারদ ঋষি তপস্যা করতে হিমালয়ে গিয়েছিলেন; যথারীতি, ইন্দ্র সন্দেহ করতে লাগলেন যে নারদ তার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবার জন্য তপস্যা করছেন। তাই তিনি কামদেব-কে পাঠান নারদের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য। কিন্তু নারদের তপস্যা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে কামদেব তা ভাঙতে ব্যর্থ হন। কামদেবকে পরাজিত করার পর নারদের অহংকার বৃদ্ধি পায় এবং তিনি ভগবান বিষ্ণু ও শিবের কাছে গিয়ে গর্ব করে তা বলে বেড়াতে থাকেন। নারদকে তার অহংকারের উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্য ভগবান বিষ্ণু একটি বিশাল, জাকজমক-পূর্ণ নগরী নির্মাণ করেন যেখানে রাজা শীলনিধি তাঁর সুন্দরী কন্যা, বিশ্বমোহিনীর জন্য একটি স্বয়ম্বর সভা আয়োজন করেন। প্রথম দর্শনেই নারদ বিশ্বমোহিনীর প্রেমে পড়ে যান কিন্তু নিজের রূপের উপর তাঁর আস্থার অভাব ছিল; তাই তিনি ভগবান বিষ্ণুর কাছে গিয়ে তাঁকে হরির মতো সুন্দর করে দেওয়ার অনুরোধ করেন। ভগবান বিষ্ণু, সুন্দর মুখশ্রীর পরিবর্তে নারদকে একটি বানরের মুখায়ব প্রদান করেন। বিষয়টি নারদের অজ্ঞাত থাকায় তিনি ঐ অবস্থাতেই স্বয়ম্বর সভায় প্রবেশ করলে সবাই তাঁকে উপহাস করতে থাকেন। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ-ধারী দুই শিবগণ তাঁকে সবচাইতে বেশী উপহাস করতে থাকেন; এর ফলে নারদ তাদের অসুর হয়ে জন্ম নেওয়ার অভিশাপ দেন। নারদ এতটাই অসম্মানিত বোধ করেছিলেন যে তিনি ভগবান বিষ্ণুকেও তাঁর প্রিয়তমা পত্নীর বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সহ্য করার অভিশাপ দেন। নারদের অভিশাপ ফলপ্রসূ করার জন্য ভগবান বিষ্ণু রামের অবতার গ্রহণ করেন এবং ঐ দুই শিবগণ রাবণ ও কুম্ভকর্ণ রূপে জন্ম নেন।
রাবণ রূপে জলন্ধর
একটি কল্পে, ভগবান শিব জলন্ধর নামক এক রাক্ষসকে বধ করেছিলেন এবং অন্য একটি কল্পে জলন্ধরের রাবণ রূপে পুনর্জন্ম হয়েছিল।
রাবণ রূপে রাজা প্রতাপভানুর পুনর্জন্ম
অনেককাল আগে প্রতাপভানু নামে এক গুণী রাজা ছিলেন যিনি তাঁর ছোট ভাই রিপুমর্দন এবং মন্ত্রী ধ্রমরুচির সহযোগিতায় তাঁর সমস্ত শত্রু-রাজাদের পরাজিত করে সহস্র যজ্ঞ সম্পন্ন করেছিলেন। একদিন একটি বন্য শুকরকে তাড়া করার সময় তিনি একজন ছদ্মবেশী ঋষির সম্মুখীন হন, যে ছিল পকৃতপক্ষে প্রতাপভানুরই অন্যতম শত্রু। অসন্দিগ্ধ-মনা রাজা ঐ প্রতারক দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েন যে তিনি তার প্রস্তাবিত একটি বিভ্রান্তিকর পরিকল্পনায় সম্মত হয়ে যান। ঐ নকল ঋষির প্রস্তাবটি ছিল যে, রাজা প্রতাপভানু যেন তার প্রাসাদে বর্ষব্যাপী ব্রাহ্মণ-ভোজনের আয়োজন করেন যার ফলস্বরূপ ব্রাহ্মণগণ সন্তুষ্ট হবেন আর প্রতাপভানু হাজার হাজার বছর ধরে সমগ্র গ্রহের অপরাজিত সম্রাট হয়ে যাবেন। কালকেতু নামক এক দানবের সহায়তায় ঐ প্রতারক একটি চক্রান্তের কৌশল রচনা করে যার অঙ্গ হিসেবে ব্রাহ্মণদের অপবিত্র খাদ্য গ্রহণ করানো হবে এবং ব্রাহ্মণগণ এর জন্য রাজা প্রতাপভানুকে দায়ী মনে করে অভিশাপ দেবেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ ঐ চক্রান্ত সফল হয়ে যায়; ব্রাহ্মণগণ নির্দোষ রাজা ও তাঁর সমগ্র পরিবার এবং মন্ত্রীদের দানব রূপে পুনর্জন্মের অভিশাপ দেন। ফলে রাজা প্রতাপভানু রাবণরূপে, ছোটভাই কুম্ভকর্ণরূপে এবং মন্ত্রী ধ্রমরুচি বিভীষণরূপে পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন। ভগবান রাম অবতার গ্রহণ করেন এবং তাঁদের পরাজিত করে দানবিক জীবন থেকে মুক্তি দান করেন।
মনু ও শতরূপার ঐশ্বরিক বর-প্রাপ্তি এবং ভগবান রামের পিতা-মাতা রূপে পুনর্জন্ম লাভ
মনু এবং শতরূপা নামে এক ভক্ত-দম্পতি পরমেশ্বর ভগবানের রামরূপে দর্শন প্রাপ্তির আকাঙ্খায় তপস্যা করছিলেন। বহুবছরের নিবেদিত তপস্যার পর ভগবান রাম ও মাতা সীতা তাঁদের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে একটি বর প্রার্থনার অনুমতি দেন। তখন মনু ও শতরূপা, ভগবান রামের মতোই এক সন্তান লাভের কামনা প্রকাশ করেন। তখন ভগবান রাম বলেন, সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে তাঁর মতো আর কেউ নেই তাই তিনি নিজে তাদের পুত্র-রূপে জন্ম নেবেন এবং তাদেরকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পিতা-মাতা হওয়ার সুখ ও সম্মান প্রাপ্তির আশির্বাদ করেন। সেই কারণে, ত্রেতাযুগে, মনু ও শতরূপা যথাক্রমে দশরথ ও কৌশল্যা রূপে পুনর্জন্ম লাভ করেন এবং ভগবান রাম তাদের পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করেন।
দেখি প্রীতি সুনি বচন অমোল। এবমস্তু করুণানিধি বোলে।।
আপু সরিস খোজৌঁ কহঁ জাই। নৃপ তব তনয় হোব মৈঁ আই।।
dekhi prīti suni bacana amole. evamastu karunānidhi bole.
āpu sarisa khojau kahaṁ jā'ī. nṛpa tava tanaya hoba mai ā'ī.
“রাজার ভালোবাসা দেখে এবং তার অমূল্য বাণী শুনে করুণানিধান ভগবান বললেন – তবে তাই হোক। হে রাজন! আমি নিজের মতো আর একজনকে খুঁজে পেতে কোথায় যাবো? তাই আমি নিজেই তোমার পুত্র হয়ে আসবো।”