Log in
English

রাধাতত্ত্ব ও রাধাষ্টমীর মাহাত্ম্য

Sep 10th, 2024 | 4 Min Read
Blog Thumnail

Category: Festivals

|

Language: Bangla

আমাদের বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে এই মুহূর্তে পরবর্তী আসন্ন উৎসব হল রাধাষ্টমী। আমাদের শাস্ত্রমতে রাধার স্থান কৃষ্ণেরও উপরে। অথচ রাধা অথবা রাধাতত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি খুবই সীমিত; বরং বহু মানুষের মধ্যেই শ্রীরাধিকাকে নিয়ে অনেক সন্দেহ বা প্রশ্ন জেগে ওঠে। তাই আমরা আজ একটু আমাদের রাধারাণীকে জানার চেষ্টা করি।

রাধা নামের অর্থ

খুব সংক্ষেপে পরিচয় দিলে রাধা হলেন আমাদের দিব্য মাতা। যেহেতু আমাদের জাগতিক জীবনে বাবার থেকেও মায়ের মধ্যেই দয়া, কৃপা, করুণার গুণগুলি বেশী মাত্রায় থাকে বলে মনে করা হয়; সেই অর্থে কৃষ্ণের থেকেও আমাদের জীবনে মা-রূপী রাধার গুরুত্ব বেশী। সেই মায়ের জন্মদিন বা প্রাকট্য দিবস হল রাধাষ্টমী।

“রাধা” শব্দের ব্যাকরণগত উৎপত্তি বোঝা যাক। সংস্কৃতে “রাধ্” ধাতুর অর্থ হল আরাধনা করা বা উপাসনা করা। পাণিনির ব্যাকরণ অনুযায়ী “রাধ্” ধাতুর সাথে করণ কারকে "আ" প্রত্যয় যোগ হয়ে “রাধা” শব্দটি গঠিত হয়েছে। আবার কর্ম কারকে “রাধ্” ধাতুর সাথে “আ” প্রত্যয় যোগ করেও "রাধা" নাম টি গঠন করা যায়। তাই রাধা শব্দটির দুটি অর্থ আছে। একটি হল - যিনি শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেন, ভক্তি করেন, উপাসনা করেন - তিনিই হলেন রাধা। দ্বিতীয় অর্থ হল - শ্রীকৃষ্ণ যাঁর আরাধনা করেন - তাঁর নাম রাধা। এই দুটি অর্থ পরস্পর বিপরীতধর্মী। এই দুটি অর্থ একইসাথে ঠিক হতে পারে কিভাবে?

শ্রীমদ্ভাগবতম্ গ্রন্থের দশম স্কন্ধের অন্তর্গত ত্রিশতম অধ্যায়ের আঠাশ নং শ্লোক অনুসারে, শ্রীকৃষ্ণ মহারাস থেকে রাধারাণীর সঙ্গে অন্তর্হিত হয়ে যাওয়ার পর গোপীরা বিরহ শোকে বিলাপ করছিলেন এবং কাতর হয়ে তাঁদের খোঁজ করছিলেন। সেইসময় বনের এক জায়গায় তাঁরা রাধাকৃষ্ণের চরণচিহ্ন দেখতে পান। রাধা এবং কৃষ্ণের চরণ কমলের বিশেষ চিহ্নসমূহ বিলক্ষণ জানতেন তাঁরা। গোপীরা আলোচনা করতে লাগলেন - আমাদের প্রিয়তম কৃষ্ণ যে গোপীকে সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছেন, তিনিই নিশ্চয় কৃষ্ণের সবথেকে বেশী আরাধনা করেছেন। আরাধনার বিচারে আমরা তাঁর তুলনায় নিতান্ত তুচ্ছ। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে রাধারাণী শ্রীকৃষ্ণের সবথেকে বড় আরাধিকা। অন্যদিকে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী, শ্রীকৃষ্ণ রাধার প্রতি বলেছেন, “হে শ্রীকিশোরী, আমার অপরাধ ক্ষমা কর, আমার উপর কৃপা কর।” এই দুই প্রকারের প্রমাণই শাস্ত্রে পাওয়া গেছে। কাজেই "রাধা" শব্দের দুটি অর্থ, আর দুটিই সঠিক।

রাধাতত্ত্বের বিশেষত্ব

 সৃষ্টি তত্ত্বের ঠিক কোন স্থানে রাধারাণীর অবস্থান – সেই বিষয়ে মানুষের মনে একটি স্বাভাবিক কৌতূহল জেগে ওঠে। আমরা সৃষ্টির মধ্যে ৩ টি সত্তার কথা জানি। একটি হলো ভোগ্য ব্রহ্ম, যাকে "মায়া" বলা হয়। দ্বিতীয়টি হল ভোক্তা ব্রহ্ম, অর্থাৎ "জীব"। তৃতীয়টি হল প্রেরক ব্রহ্ম, অর্থাৎ "ভগবান"। তাই বেদ অনুযায়ী তিনটি সত্তা হল মায়া, জীব এবং ভগবান। এই তিনটি তত্ত্ব অনেক বেদমন্ত্রে উল্লিখিত আছে। এই তিনটির মধ্যে রাধার স্থানটি ঠিক কোথায়? মায়া? জীব? নাকি ভগবান? পদ্ম পুরাণে বেদব্যাস লিখেছেন, শ্রীরাধা হলেন শ্রীকৃষ্ণের আত্মা। তাহলে কি রাধা কোন চতুর্থ তত্ত্ব? এর উত্তর হল – না; কারণ অন্যান্য জীবের শরীর ও আত্মা ভিন্ন হলেও শ্রীকৃষ্ণের আত্মা এবং শরীরের মধ্যে কোন ভেদ নেই। রাধা হলেন শ্রীকৃষ্ণের সুখদানকারী সত্তা। তাই রাধারাণীকে বলা হয় শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি, অর্থাৎ যিনি শ্রীকৃষ্ণকে আহ্লাদ (আনন্দ) দেন। রাধা হলেন শক্তি; কৃষ্ণ শক্তিমান। তাঁরা হলেন এক এবং অদ্বিতীয়। যেমন দুধ এবং তার শুভ্রতাকে আলাদা করা যায় না; যেমন চন্দ্র এবং তার প্রভাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না – ঠিক সেভাবেই রাধা এবং কৃষ্ণ কে আলাদা করা সম্ভব নয়। শাস্ত্র-পুরাণে কোথাও শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন – “আমিই রাধা”; আবার কোথাও রাধা বলেন – “আমার পুরুষ রূপই হল গোপীদের প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণ”। নারদপঞ্চরাত্রতে বলা আছে –শ্রীকৃষ্ণের অর্ধাংশ রাধা; রাধার অর্ধাংশ শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণ ও রাধার মন, বুদ্ধি, জ্ঞান, আত্মা – সব এক। যদিও রসিক সন্তেরা হাসির ছলে কেউ বলে থাকেন কৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ; কেউ বা বলেন রাধাই শ্রেষ্ঠ – কিন্তু রাধা ও কৃষ্ণের মধ্যে ভেদবুদ্ধি রাখা নামাপরাধ।

রাধাতত্ত্ব  অত্যন্ত গুহ্য (রহস্যময়)। অথর্ববেদীয় রাধেকোপনিষদ অনুসারে, এই রাধারই অংশ প্রকাশ পেয়েছে শৈলপুত্রী পার্বতী এবং মহালক্ষী রূপে। সেই রাধাকে আমরা বিনম্র প্রণাম জানাই। এবং সেই একই অথর্ববেদীয় রাধেকোপনিষদে বলা আছে, যাঁর পদধূলি শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মস্তকে ধারণ করেন - তিনিই রাধা।

শ্রীমদ্ভাগবতম্ গ্রন্থে রাধা নামের অনুপস্থিতির রহস্য 

 শ্রীমদ্ভাগবতম্ গ্রন্থকে সকল বেদশাস্ত্রের সার বলে মনে করা হয়। কিন্তু এ হেন গুরুত্বপূর্ণ রাধাতত্ত্ব শ্রীমদ্ভাগবতম্ গ্রন্থে স্থান পায়নি কেন? ভাগবতে রাধা নামের কোন উল্লেখ নেই কেন? এই প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে বহুবার এসেছে।

আচার্যরা এর সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন - ভাগবতমে রাধা নামের প্রত্যক্ষ উল্লেখ নেই ঠিকই; কিন্তু তাঁর উল্লেখ অন্য নামে আছে। ভাগবতের বক্তা শুকদেব পরমহংস পরোক্ষভাবে রাধা নামের উল্লেখ করতে বাধ্য হয়েছেন। রাধারাণীর আদরের শুক-সারির শুকই বেদব্যাসের পুত্র "শুকদেব" রূপে পরীক্ষিতকে ভাগবত শোনান। রাধার প্রতি তাঁর প্রেম এতটাই গভীর যে তিনি যদি একবার রাধা নাম উচ্চারণ করেন তাহলে তিনি ছয় মাসের জন্য মূর্ছা যান। শৃঙ্গী মুনির দেওয়া অভিশাপের ফলে মহারাজা পরীক্ষিতের হাতে, মৃত্যুর আগে, মাত্র ৭ দিন সময় ছিল। শুকদেবকে সাত দিনের মধ্যে ভাগবতম শেষ করতে হত। এর মাঝে যদি তিনি রাধা নাম উচ্চারণ করতেন তাহলে হয়তো তিনি ছয় মাসের জন্য মূর্ছা যেতেন এবং পরীক্ষিত মহারাজ ভাগবতম থেকে বঞ্চিত হতেন। পুরো বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তাই শুকদেব মহারাজজী সরাসরি রাধা নামের উল্লেখ করেননি। তিনি পরোক্ষভাবে ইঙ্গিতের মাধ্যমে রাধাকে বুঝিয়েছেন ভাগবতমে। রাধারাণী শ্রীমদ্ভাগবতমে “রমা”, “শ্রী”, “গোপী” প্রভৃতি নামে উল্লিখিত হয়েছেন। এছাড়া ভাগবতমের রচয়িতা বেদব্যাস আরো ১৭ টি পুরাণ লিখেছেন যেখানে তিনি "রাধা" নামের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন।

রাধারাণীর প্রতি আমাদের কর্তব্য

রাধারাণী হলেন যোগমায়া শক্তি। ভগবান যা কিছু করেন - তা এই যোগমায়া শক্তির গুণের কারণেই করেন। রসিক সন্ত, যাঁরা কিছুটা হলেও রাধাতত্ত্ব বোঝেন, তাঁরা রাধারাণীর চরণে নিজেদের সমর্পণ করেন। তাঁরা বলেন এটিই কৃষ্ণভক্তির শ্রেষ্ঠ পন্থা। কারণ কৃষ্ণকে কিভাবে খুশি করতে হয়, কিভাবে সেবা করতে হয় - তা রাধারাণীর থেকে ভাল আর কে বেশি জানে? তাই চলুন, আমরা বরং রাধারাণীকে কৃষ্ণের সেবায় সাহায্য করি। আর এটিই হল "সখী"ভাব। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ স্থিতি – যার মূলমন্ত্র হল - নিজের সুখের কথা না ভেবে শুধু প্রিয়তমকে খুশি রাখার চেষ্টা। তাই এটি হল ভক্তির অন্যতম উচ্চ স্তর।

“রাধে রাধে” এর সঠিক ব্যাখ্যা

একটি প্রশ্ন আমাদের বহুবার শুনতে হয় - কেন আমরা সব সময় "রাধে রাধে" বলি। আসলে পুরো কথাটা হল "রাধে রাধে - শ্যাম সে মিলাদে"। অর্থাৎ, "প্রিয় রাধারানী, দয়া করে পরম পিতা শ্রীকৃষ্ণের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ করিয়ে দাও"।

রাধারাণীর কাছে প্রার্থনা

রাধা সর্বোচ্চ প্রেম ও ভক্তির প্রতীক। ভগবদ্প্রাপ্তির পরেও প্রেমভক্তির যে যে সোপান রয়েছে, তার শিখরে আছেন মাদনাখ্য মহাভাবের একমাত্র অধিকারিণী রাধারাণী। রসিক সন্তেরা বলেন, তাঁর সমস্ত সত্তাই কৃপা দ্বারা নির্মিত। তিনি কারোর উপর কখনো রুষ্ট হতে পারেন না। অধম সন্তানদের অকারণেই শুধু কৃপা দান করার জন্য উদগ্রীব থাকেন তিনি। তাঁর অসীম করুণা স্মরণ করে তাঁর দিব্যপ্রেমের ছিটেফোঁটা অংশের জন্য অনুরোধ জানাই আমরা; যাতে আমরা সেই দিব্যপ্রেম লাভ করে রাধাকৃষ্ণের চিরন্তন সেবায় নিযুক্ত হয়ে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারি।