Log in
English

অক্ষয় তৃতীয়া: শাশ্বত শুভ দিবস

May 10th, 2024 | 4 Min Read
Blog Thumnail

Category: Festivals

|

Language: Bangla

সসংস্কৃতে 'অক্ষয়' (অক্ষয়/अक्षय) শব্দটি তৈরী হয়েছে : 'অ' (না) + 'ক্ষয়' = অক্ষয়। এটি এমন কিছুকে বোঝায় যা ক্ষয় বা হ্রাস পায় না। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে 'তৃতীয়া', তৃতীয় চন্দ্র দিবসকে বোঝায়। এইভাবে, অক্ষয় তৃতীয়া বৈশাখ মাসের তৃতীয় চন্দ্র দিবসে (এপ্রিল-মে) উদযাপিত অক্ষয় আশীর্বাদ লাভ করার একটি উৎসব।

অক্ষয় তৃতীয়ার তাৎপর্য

  • আধ্যাত্মিক উন্নতি: যারা আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্য এই দিনটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ধ্যান, আত্ম-প্রতিফলন, এবং দাতব্য কাজগুলি আত্মাকে পরিপুষ্ট করে এবং অভ্যন্তরীণ পরিপূর্ণতার দিকে পরিচালিত করে বলে বিশ্বাস করা হয়। বিশেষ পূজা, পূর্বপুরুষদের সম্মান জ্ঞাপন করা এবং পবিত্র গ্রন্থ অধ্যয়ন করা হলো সাধারণ রীতি।
  • শুদ্ধিকরণ এবং পুনর্নবীকরণ: অক্ষয় তৃতীয়া, পরশুরাম জয়ন্তী এবং গঙ্গা সপ্তমী (একই মাসের সপ্তম চন্দ্র দিনে) একই সময়কালে উজ্জাপিত হয়। সূর্য ও চন্দ্রের অনুকূল অবস্থান মন ও শরীরের শুদ্ধিকরণ করার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
  • আশীর্বাদ এবং সমৃদ্ধি: যেহেতু এটি ত্রেতাযুগের সূচনাকে চিহ্নিত করে, অক্ষয় তৃতীয়াকে ঐশ্বরিক (দিব্য) আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য বিশেষভাবে শুভ বলে মনে করা হয়। এই দিনে সোনা কেনা একটি জনপ্রিয় ঐতিহ্য, যা সম্পদ ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদের প্রতীক। এটি আশা ও আশাবাদের জন্য একটি উপযুক্ত সময় এবং অন্তহীন সৌভাগ্যের আবাহন।

অক্ষয় তৃতীয়ার উৎপত্তি সংক্রান্ত বারোটি কাহিনী

  1. মাতা লক্ষ্মীর আবির্ভাব: পৌরাণিক বিবরণ অনুযায়ী ক্ষীরসাগর মন্থনের সময় মাতা লক্ষ্মীর আবির্ভাব ঘটে এবং এই দিনে তাঁকে সম্পদ ও সমৃদ্ধির দেবী ঘোষণা করা হয়।
  2. ভগবান পরশুরামের জন্ম: ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম অক্ষয় তৃতীয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। ব্রাহ্মণ হলেও তিনি ক্ষত্রিয়ের মতো যোদ্ধা গুণের অধিকারী ছিলেন।
  3. সুদামার অর্ঘ্য এবং অক্ষয়পাত্র: শ্রীকৃষ্ণের একজন দরিদ্র বন্ধু - সুদামা - এক মুঠো মুড়ি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে। সুদামার ভক্তি দ্বারা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কুঁড়েঘরটিকে কৃষ্ণ একটি প্রাসাদে রূপান্তরিত করেছিলেন, যা অক্ষয় নিধির (শাশ্বত সম্পদের) প্রতীক।
  4. যুধিষ্ঠির অক্ষয় পাত্র লাভ করেন: মনে করা হয় যে, এই শুভ দিনে সূর্যদেব যুধিষ্ঠিরকে অক্ষয় পাত্র দান করেছিলেন। অক্ষয় পাত্র হল একটি জাদুকরী পাত্র যাতে কখনই খাবার ফুরিয়ে যায় না। 
  5. মহাভারতের সূচনা: জনশ্রুতি আছে যে - অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেই মহর্ষি বেদব্যাস মহাকাব্য মহাভারত বর্ণনা করতে শুরু করেছিলেন এবং ভগবান গণেশ তা লিখতে শুরু করেছিলেন। 
  6. অন্নপূর্ণার আবির্ভাব: এই দিনে অন্নপূর্ণা রূপে মাতা পার্বতী শিবের সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁকে প্রচুর পরিমাণে খাবার প্রদান করেছিলেন।
  7. ত্রেতাযুগের সূচনা: ভবিষ্য পুরাণ অনুযায়ী, অক্ষয় তৃতীয়ায় ত্রেতাযুগের (হিন্দু বিশ্বতত্ত্বের চারটি যুগের মধ্যে দ্বিতীয় যুগ) সূচনা হয়। সেই কারণে এই দিনটির মাহাত্ম্য অসীম; যে কোনো ভালো কাজ এই দিনে করলে চিরন্তন ফল পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করা হয়।
  8. দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা: মহাভারতের কুখ্যাত পাশা খেলার সময় বিপন্ন দ্রৌপদীকে অক্ষয় বস্ত্র (অন্তহীন শাড়ি) প্রদান করে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সম্মান রক্ষা করেছিলেন।
  9. মন্দোদরীর জন্ম: অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে ভগবান বিষ্ণু চন্দন বাটা থেকে সৃষ্টি করেন মন্দোদরীকে - যিনি পঞ্চকন্যাদের মধ্যে অন্যতম। রাবণকে বিয়ে করা সত্ত্বেও মন্দোদরী পুণ্যাত্মা এবং ধার্মিক ছিলেন - এমনকি রাবণকে খারাপ পথে না যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
  10. পৃথিবীতে গঙ্গার অবতরণ: এই দিনে গঙ্গা নদী স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন।
  11. কুবেরের নিয়োগ: কুবের মাতা লক্ষ্মীর উপাসনা করেছিলেন, ফলে তাঁকে অক্ষয় তৃতীয়ায় দেবতাদের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
  12. লক্ষ্মী ব্রত: বিশ্বামিত্র এবং অন্যান্য মহান ঋষিরা অক্ষয় তৃতীয়ায় লক্ষ্মী ব্রত পালন করেছিলেন এবং তাঁদের বাড়িতে বা আশ্রমে কোনোদিন কোনও অভাব অনুভব করেননি।

অক্ষয় তৃতীয়ায় সোনা কেনার কারণ

  • সম্পদের জন্য শুভ সময়: অক্ষয় তৃতীয়াকে সম্পদ, বিশেষ করে সোনায় বিনিয়োগ করার জন্য সবচেয়ে শুভ দিন বলে মনে করা হয়। কুবের এই দিনে দেবতাদের কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হওয়ার কারণে এই দিনে কেনা সোনা দীর্ঘস্থায়ী সমৃদ্ধি আনতে পারে বলে মনে করা হয়। 
  • বিবাহের পরিকল্পনা: অক্ষয় তৃতীয়া এবং শ্রাবণের মধ্যবর্তী সময়টি (জুলাই-আগস্ট) বিবাহের জন্য শুভ বলে মনে করা হয়। রীতি অনুসারে, পরিবারগুলি আসন্ন বিবাহের প্রস্তুতির জন্য অক্ষয় তৃতীয়ার সময় সোনার অলঙ্কার ক্রয় করে।

অক্ষয় তৃতীয়া: দান করার দিন

প্রথা অনুযায়ী, অক্ষয় তৃতীয়াকে বস্তুগত সম্পদ উপার্জনের পরিবর্তে অন্যদের সাহায্য করার দিকে মনোনিবেশ করার সময় হিসাবে দেখা হয়। অক্ষয় তৃতীয়ায় আপনার দাতব্য কাজগুলি কীভাবে আশীর্বাদ আনতে পারে তা এখানে বলা হয়েছে :

  • মৃত্যুর ভয়কে জয় করা: দান কর্মের পুণ্যলাভ, মৃত্যুভয় কাটিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ রূপান্তর নিশ্চিত করতে সাহায্য করে বলে বিশ্বাস করা হয়।
  • পরবর্তী জীবনে আশীর্বাদ: এই শুভ দিনে অন্যদের সাহায্য করা আপনার পরবর্তী জন্মে আশীর্বাদ নিয়ে আসে বলে মান্যতা আছে।
  • উন্নততর পূর্ণতা অর্জন: দাতব্য কর্ম হিসাবে আহারে ফল দানের মাধ্যমে এই জীবদ্দশায় উন্নততর পরিপূর্ণতা লাভ করা যায় বলে বিশ্বাস করা হয়।
  • অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠা: বস্ত্র দান সুস্বাস্থ্য আনয়ন এবং অসুস্থতা নিরাময় করে বলে মানা হয়।
  • শান্তি ও সমৃদ্ধি: যাঁরা শস্য দান করেন তাঁরা সমৃদ্ধ ও শান্তিময় জীবন লাভ করেন বলে কথিত আছে।
  • দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হওয়া: "দেব তর্পণম" (দেবতাদের উদ্দেশে একটি আচার-অনুষ্ঠান) অর্পণ করা দারিদ্র্য দূর করতে সাহায্য করে বলে বিশ্বাস করা হয়।
  • ক্ষমা প্রদান করা: দই ভাত প্রদান করা আপনাকে অতীতের অপরাধের জন্য ক্ষমা পেতে সাহায্য করে বলে মনে করা হয়।

অক্ষয় তৃতীয়া কীভাবে উদযাপন করবেন?

  • পূজা: 
    • আপনার ইষ্ট দেবতার (নির্বাচিত দেবতা) মূর্তিকে চন্দন বাটা, অক্ষতা (সিঁদুর চাল) এবং তুলসী জল দিয়ে অভিষেক করুন।
    • উপবাস (ব্রত) পালন করুন।
  • দান কর্ম:
    • একটি অলাভজনক সংস্থাকে আর্থিক অনুদান।
    • অভাবগ্রস্ত মানুষকে দান করুন: চাল, লবণ, ঘি, শাকসবজি, ফল, কাপড়, দই, নারকেল ইত্যাদি।
    • নির্দিষ্ট দান: জলদান (সুপারি সহ জলের পাত্র), শয়ান দান (বিছানা), বস্ত্রদান, কুমকুম (সিঁদুর), চন্দন, কুম্ভ (জলের পাত্র), পদরক্ষা (পাদুকা) এবং ছত্র (ছাতা)।
  • আঞ্চলিক প্রথা (পূর্ব ভারত): 
    • শস্য বপনের শুরু করার জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে মাটি কর্ষণ শুরু করা হয়।
    • নতুন আর্থিক হিসাব বই (অ্যাকাউন্ট বুক) খোলা হয় ।
  • আধ্যাত্মিক অনুশীলন:
    • শাস্ত্র পাঠ শুরু করুন বা আপনার সাধনা (ভক্তিমূলক অনুশীলন) শুরু করুন।
    • ভজন, কীর্তন, রূপধ্যান সাধনে মগ্ন হোন।

অক্ষয় তৃতীয়া হল একটি বহুমুখী উৎসব যা আধ্যাত্মিক উন্নতি, পরিশুদ্ধি, বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির সুযোগ দেয়। এটি নতুন কিছু শুরু করার দিন যা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে। অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে, আপনি অন্যের মঙ্গল সাধন করতে পারেন এবং নিজেকে আশীর্বাদের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে পারেন।