জন্মাষ্টমী হিন্দুধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। জন্মাষ্টমী দিয়েই বছরের উৎসবের মরসুম শুরু হয় যা দীপাবলীর সময়ে শেষ হয়। অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ড-নায়ক যে ইশ্বর আত্মাকে জন্ম ও মৃত্যুর চক্র থেকে উদ্ধার করেন, সমস্ত ভক্তেরা একত্র হয়ে জন্মাষ্টমীর দিনে তাঁকেই শিশুরূপে স্নেহভরে আলিঙ্গন করার জন্য সারাবছর ধরে অপেক্ষা করে থাকে।
আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের ঘটনা। সর্বব্যাপ্ত, অসীম মহাবিশ্বের মালিক এই পৃথিবীতে তাঁর ব্যক্তিগত রূপে অবতরণ করেছিলেন এবং এমন দুর্দান্ত লীলা প্রদর্শন করেছিলেন যা সকলের মনকে আজও আকৃষ্ট করে চলেছে। পরমপিতা শ্রীকৃষ্ণ হয়ে গেলেন নন্দ ও যশোদার স্নেহের দুলাল। বেদে ঈশ্বরের সম্পর্কে বলা আছে যে তাঁর কোন শুরু বা শেষ নেই, তিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক, তাঁর বিস্তৃতির সীমা নেই। সেই অনাদি অনন্ত ঈশ্বর মা যশোদার প্রেমের দড়িতে বাঁধা পড়ে গেলেন!
বেদে ঈশ্বরের ঐশ্বর্য বর্ণনা করা আছে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের অনেকগুলি গুণ বা মাধুরীর মধ্যে অন্যতম হল প্রেম মাধুরী। সেই প্রেম মাধুরীই জন্মাষ্টমীর তিথিতে উদ্যাপিত হয়, যা নিঃস্বার্থ প্রেম বা ভক্তিকে উৎসাহিত করে, যা সর্বশক্তিমান ভগবানকে তাঁর ভক্তদের দাস করে তোলে।
বিশ্বাসের অভাবের কারণে, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম এবং অস্তিত্বকে ঘিরে কিছু সাধারণ প্রশ্ন জেগে উঠে। সেগুলি তাঁর প্রতি ভালবাসার বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। শ্রীকৃষ্ণ কি সত্যিই ছিলেন? নাকি তাঁর আবির্ভাব নিছকই কোনো গল্পকথা? ঈশ্বর কি সাধারণ শিশুর মতো জন্মগ্রহণ করেন? ঈশ্বর যদি একটি রূপ ধারণ করেন, তবে তিনি একই সময়ে একাধিক স্থানে কীভাবে বিদ্যমান থাকতে পারেন? সাধারণ মানুষের মনে এই প্রশ্নগুলি জেগে ওঠা স্বাভাবিক। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শাস্ত্র অথবা সাধুসন্তের শরণাপন্ন হতে হবে। জ্ঞানের বিকাশ হলে বিশ্বাস জন্মায়; আর বিশ্বাস বাড়লে ভালবাসা প্রগাঢ় হয়। আসুন, আমরা চেষ্টা করে দেখি কীভাবে এই প্রশ্নগুলির বিশ্বাসযোগ্য উত্তর পাওয়া যায়। তাহলে মানবজীবনের উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য - ঈশ্বরের প্রতি নিঃস্বার্থ প্রেম ও ভক্তি গড়ে তোলার দিকে আমরা এক ধাপ এগোতে পারব।
ভগবান কেন অবতার রূপ গ্রহণ করেন ?
ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
ধার্মিকদের রক্ষা করতে, দুষ্টদের বিনাশ করতে এবং ধর্মের নীতিগুলিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে আমি যুগে যুগে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হই।
(- ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ৪ শ্লোক ৮)
ভেবে দেখুন, এসব কাজ করার জন্য সত্যিই কি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে ব্যক্তিগত রূপ ধারণ করতে হয়? যে ভক্তেরা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে - ভগবান তো সবসময়ই সেই ভক্তদের রক্ষা করে চলেছেন; ঠিক যেমন করে মা সন্তানের খেয়াল রাখেন।
কারণ হরি অবতার কো, কৃপা অকারণ জান।
অপর জিতে কারণ কহে, তিনহিঁ গৌণ করি মান।।
(- ভক্তি শতক, শ্লোক ৫৬, জগদগুরু শ্রী কৃপালুজী মহারাজ)
ভগবানের অবতার গ্রহণের যে যে কারণ শাস্ত্রে বর্ণিত আছে – সেসবই ঠিক; কিন্তু সর্বপ্রধান কারণ হল – এই পৃথিবীর সমস্ত জীবাত্মাকে অহৈতুকী কৃপা প্রদান করা।
ঈশ্বর অবতীর্ণ হওয়ার আসল কারণ হল - তাঁর ভক্তদের মনকে শুদ্ধ করতে সাহায্য করা। তাঁর দিব্য নাম, রূপ, লীলা, গুণ এবং ধাম নিয়ে ভক্তরা যাতে ডুবে থাকতে পারে এবং এগুলির মাধ্যমে যাতে অবিচল ভক্তির ভিত স্থাপিত হয় - এটাই ঈশ্বরের অবতার গ্রহণের প্রধান রহস্য।
দিব্য জন্ম: কৃষ্ণলীলার সূচনা
কৃষ্ণের প্রতি সাধারণ মানুষের চিরন্তন আকর্ষণ; প্রধানত তাঁর বিপরীতধর্মী গুণের কারণে। একদিকে যেমন তিনি আমাদের প্রেমের ঠাকুর; অন্যদিকে সুকৌশলী কূটনীতিক। কখনও তাঁর মধ্যে গ্রামের রাখাল বালকের সরলতা; আবার কখনও তুখোড় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। এহেন কৃষ্ণের জীবনে কি কখনও কিছু সহজ ছিল? এমনকি তাঁর জন্মকাহিনীও দিব্য রহস্যপূর্ণ!
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে মধ্যরাতে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর পিতামাতা ছিলেন বাসুদেব এবং দেবকী। দেবকীর দাদা কংস তাঁদের কারাগারে বন্দী করে রেখেছিলেন। তাই রাজপুত্র হওয়া সত্ত্বেও রাজপ্রাসাদে জন্ম না নিয়ে মথুরায় কংসের বন্দীগৃহে আবির্ভূত হন শ্রীকৃষ্ণ। অবশ্য আর পাঁচটা জাগতিক মানুষের মত জন্ম হয়নি তাঁর।
শ্রীমদ্ভাগবত অনুসারে, কৃষ্ণ দেবকীর গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেননি। ভগবান বিষ্ণু চতুর্ভূজরূপে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করে বাসুদেব এবং দেবকীকে দর্শন দেন। দেবকী বুঝতে পারলেন যে তাঁর আসন্ন সন্তান স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। তিনি ভগবানের স্তুতি গাইতে শুরু করেন। দেবকী বাৎসল্যভাবে ভগবানের ভক্তি করতেন। পূর্বজন্মে ভগবান বিষ্ণুর কাছে দেবকী বর প্রার্থনা করেছিলেন যেন ভগবানকে তিনি সন্তানরূপে লাভ করতে পারেন; যাতে তাঁর প্রতি মাতৃস্নেহ উজাড় করে দিতে পারেন। পূর্বজন্মের সেই স্মৃতির বিস্মৃতি হয়নি তাঁর। দেবকী ভগবান বিষ্ণুকে জিজ্ঞাসা করেন – এমন চতুর্ভূজ স্বরূপ দেখলে তিনি কীভাবে তাঁকে নিজের সন্তান হিসাবে গ্রহণ করতে পারবেন? ভগবানের ঐশ্বর্যময় রূপ দেখলে কি আর তাঁকে নির্মল সন্তান-স্নেহ প্রদান করা অথবা শাসন করা সম্ভব?
ভগবান তাঁর ভক্তদের মনের ভাব বোঝেন। তাই, তাঁর যোগমায়া শক্তি ব্যবহার করে, ভগবান দেবকীকে তাঁর দিব্য জন্মের কথা ভুলিয়ে দেন এবং নিজে ছোট্ট শিশু কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হন। যোগমায়া কৃষ্ণকেও ভুলিয়ে দিয়েছিল যে তিনি ভগবান; যাতে তিনি অন্যান্য শিশুদের মতই মায়ের কাছে অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করে অনাবিল মাতৃস্নেহ অনুভব করতে পারেন। কৃষ্ণলীলা এমনই অদ্ভুত!
কৃষ্ণের জন্মের সময়ে কারাগারের প্রহরীরা ঘুমিয়ে পড়েছিল। কারাগারের দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল, বাসুদেবের শিকল ভেঙে গেল। বাসুদেব ছোট্ট শিশু কৃষ্ণকে তুলে নিয়ে ব্রজভূমির উদ্দেশ্যে রওনা দেবার জন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন। তিনি যখন যমুনা নদীর কাছে গেলেন তখন ভারী বৃষ্টির কারণে যমুনায় প্রবল স্রোত। সেই স্রোতের মধ্যে বাসুদেব ছোট্ট কৃষ্ণকে একটি ছোটো ঝুড়িতে করে মাথায় নিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করলেন। যমুনা তাঁর ইষ্টদেবতার ছোট্ট দুটি দিব্য চরণ স্পর্শ করার জন্য আনন্দে প্লাবিত হচ্ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, বাসুদেব এক হাঁটু জল এর মধ্য দিয়ে যমুনা নদী পেরিয়ে গেলেন।
তিনি ব্রজভূমিতে নন্দ ও যশোদার বাড়িতে গেলেন। যশোদা সবেমাত্র একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছিলেন এবং অজ্ঞান হয়ে শুয়েছিলেন। সেই কন্যার জায়গায় বাসুদেব কৃষ্ণকে রেখে দেন এবং কন্যাশিশুটিকে নিয়ে মথুরার কারাগারে ফিরে আসেন।
জন্মাষ্টমী উদ্যাপন
সারা বিশ্বে কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী পালিত হয় ভক্তিমূলক নৃত্য, গান, আরতি, শঙ্খধ্বনি এবং ছোট্ট শ্রীকৃষ্ণকে দোলনায় দোলানোর মাধ্যমে । এই দিনে কৃষ্ণের দিব্য জন্মের মধুর লীলাকে স্মরণ করার জন্য মন্দির এবং গৃহস্থের ঘর সজ্জিত এবং আলোকিত করা হয়।
জন্মাষ্টমীর শিক্ষণীয় বিষয়
তাহলে, কী বোঝা গেল? এই কৃষ্ণলীলা আমাদের শিক্ষা দেয় যে আমরা, অর্থাৎ সাধারণ মানুষেরা, ঈশ্বরের অসাধারণ লীলাগুলি যে সব ঠিকঠাক বুঝতে পারব – তা একেবারেই নয়। তাই বুদ্ধিকে একপাশে সরিয়ে রেখে বিশ্বাসের সাথে তা গ্রহণ করতে হয়। আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি জাগতিক এবং সীমিত; তা দিয়ে কৃষ্ণলীলা, অথবা যে কোন দিব্য লীলা পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়।
জন্মাষ্টমীর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল – সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ভগবত্তা দূরে সরিয়ে রেখে সন্তানস্নেহে ভগবানের প্রতি ভক্তি জাগিয়ে তোলা।