Log in
English

প্রথম রথযাত্রা: চৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তি এবং রাধা কৃষ্ণ সংযোগ

Jul 5th, 2024 | 5 Min Read
Blog Thumnail

Category: Festivals

|

Language: Bangla

শ্রীকৃষ্ণ এবং ব্রজের গোপীদের মধ্যে যে গভীর ভক্তিমূলক মধুর লীলার সম্পর্ক ছিল - রথযাত্রার তাৎপর্য ততখানিই গভীর। বেশিরভাগ লোকই রথযাত্রার কিংবদন্তির সাথে পরিচিত, যেমনটি আধুনিক সময়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে এবং ভারতীয় প্রবাসীদের দ্বারা জনবহুল বিশ্ব জুড়ে পরিলক্ষিত হয়। আপনি কি মানবজাতির ইতিহাসের প্রথম রথযাত্রা সম্পর্কে জানেন? স্বামী মুকুন্দানন্দ দ্বারা বর্ণিত এই অপূর্ব সুন্দর লীলা থেকে মিষ্টি রস আস্বাদন করুন!

রথযাত্রার সূত্রপাত  

বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম রথযাত্রা হয়েছিল দ্বাপর যুগে। কিভাবে তা হয়েছিল সে সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। 

প্রাচীন রীতি অনুযায়ী, সূর্য গ্রহণের সময় হাজার হাজার ভক্ত কুরুক্ষেত্রের কাছে ব্রহ্ম কুণ্ডে(হ্রদে) স্নান করতে সমবেত হয় । বিশ্বাস করা হয় যে এই পবিত্র কুণ্ডে স্নান করলে অশ্বমেধ যজ্ঞ করার মতোই পুণ্য অর্জন করা যায়। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে, শ্রীকৃষ্ণের সময়েও এই রীতি প্রচলিত ছিল। শ্রীকৃষ্ণ, তাঁর লীলার অংশ হিসাবে, অন্যান্য যদুবংশীয়দের মতো তাঁর ১৬,১০৮ রানীদের সাথে ব্রহ্ম কুণ্ডে গিয়েছিলেন। রাধারানী ও গোপীরাও ব্রজ থেকে ব্রহ্ম কুণ্ডে গিয়েছিলেন।

রাধারানী এবং গোপীরা শ্রীকৃষ্ণকে যারপরনাই ভালবাসতেন। তা সত্বেও তাঁদের বিরহ যন্ত্রণা দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ব্রজ ত্যাগ করেন। সেই ঘটনার একশত বছর পেরিয়ে গিয়েছে। যদিও বিরহ শুধুমাত্র বাহ্যিক ছিল, কারণ গোপীদের মন সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণ চিন্তায় মগ্ন ছিল। দিব্য বিরহের যন্ত্রণা তাঁদের বিশুদ্ধ প্রেমকে আরও তীব্র এবং নিঃস্বার্থ করে তুলেছিল। এতদিন পরে যখন তাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে দেখলেন, তখন তাঁদের আনন্দ সীমাহীন। কিন্তু দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যময় রূপ দেখে বৃন্দাবনের মতো মধুর আনন্দ অনুভব করেননি তাঁরা। তাই গোপীরা কৃষ্ণকে ব্রজে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করেন - যাতে প্রিয় শ্যামসুন্দরকে প্রেমময় রূপে দেখে সেই আগের মত ব্রজরস অনুভব করা যায়। শ্রীকৃষ্ণেরও অনুরূপ ইচ্ছা ছিল - তাই তিনি রাজি হলেন।

গোপীরা একটি রথ তৈরি করেছিলেন যার উপরে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবলরাম এবং সুভদ্রাদেবীকে বসিয়ে কুরুক্ষেত্র থেকে ব্রজ পর্যন্ত রথ টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের নিঃস্বার্থ প্রেম এবং তীব্র ভক্তি প্রত্যক্ষ করে এমন দিব্য পরমানন্দ অনুভব করেছিলেন যে তিনি মহাভাব সমাধি অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁর চোখদুটি প্রসারিত এবং তাঁর শরীর শিথিল হয়ে গিয়েছিল। তাঁর দিব্য আনন্দময় অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে, শ্রীবলরাম এবং সুভদ্রাদেবীও মহাভাব সমাধি লাভ করেন। রথ যখন ব্রজে পৌঁছায়, তখন সমস্ত ব্রজবাসী আবার তাঁদের প্রিয় শ্যামসুন্দরকে ফিরে পেয়ে সেই মধুর আনন্দ অনুভব করেন - কারণ ভগবান তাঁর ঐশ্বর্যপূর্ণ রূপ ত্যাগ করে বন্ধু, শিশু এবং প্রিয়তমের রূপ ধারণ করেছিলেন!

যুগের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম রথযাত্রা। কিন্তু আধুনিক যুগে রথযাত্রা কীভাবে জনপ্রিয় হল?

চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব রহস্য 

এই বিশ্ব-সংসারের সর্বোচ্চ স্থিতি হল শ্রীকৃষ্ণের প্রতি রাধারানীর নিঃস্বার্থ প্রেম। এমনকি, ভগবান কৃষ্ণও রাধার প্রেমের প্রতি কৌতূহলী এবং তাঁর মনে প্রথম প্রশ্ন জেগে উঠে, "রাধার প্রেমের প্রকৃতি কি? আমি এটা বুঝতে অক্ষম। যদি আমি রাধা হতে পারি, তাহলে রাধার প্রেম আমি অনুভব করতে পারব। রাধা হয়ে যখন আমি কৃষ্ণভক্তি করব, অর্থাৎ আমার নিজের প্রতিই ভক্তি করব, একমাত্র তখনই এই প্রেমের স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব।"

দ্বিতীয় প্রশ্ন কৃষ্ণের মনে জেগে উঠে, “আমার মধ্যে এমন কী আছে যেটা রাধাকে এতখানি আকর্ষিত করে? ‘কৃষ্ণ’, ‘কৃষ্ণ’, ‘কৃষ্ণ’! তাঁর শরীরের প্রতিটি রোমকূপ থেকে সবসময় ‘শ্যাম’, ‘শ্যাম’, ‘শ্যাম’ ধ্বনিত হচ্ছে।” 

তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, “রাধারানী আমার প্রতি ভক্তিতে কি ধরণের আনন্দ অনুভব করেন?”

তাই এই তিনটি কৌতূহল নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন যে “আমাকে অবশ্যই রাধা হতে হবে।” এখন তিনি তো তাঁর দিব্য লীলাতে রাধা হতে পারেন না। তাই তিনি তাঁরই নিজের প্রধান ভক্তরূপে ‘রাধা’-ভাবে অবতীর্ণ হন। রাধারানীর গভীর এবং তীব্র প্রেম অনুভব করার জন্য, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অবতারে শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন। মদনাখ্য মহাভাবের সর্বোচ্চ রূপ - যা একচ্ছত্রভাবে শুধুমাত্র রাধারানীর হৃদয়ে অবস্থান করে, ‘রাধা’-ভাবে আবির্ভূত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর হৃদয়েও তা বিদ্যমান ছিল।

চৈতন্য মহাপ্রভুর বিমোহন 

চৈতন্য মহাপ্রভু পুরীতে (আধুনিক ওড়িশা, ভারতে) থাকতেন, যেখানে রথযাত্রার ঐতিহ্য ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। তিনি জগন্নাথকে ‘প্রিয়তম কৃষ্ণ’-ভাবে দেখতেন। তীব্র অনুরাগের সাথে তিনি প্রভু জগন্নাথের দর্শনে যেতেন। তাঁর সম্পর্কে অনেক বিস্ময়কর লীলা আছে যার মাধ্যমে তিনি আমাদের কৃষ্ণভক্তি শিখিয়েছেন। 

চৈতন্য মহাপ্রভু মূর্তির কাছে যেতেন না। তিনি বলতেন যে,"যদি আমি কাছে যাই তাহলে দোষ বুদ্ধির (খুঁত দেখার বুদ্ধি) বিকাশ হতে পারে। যদি আমি দেখি যে বিগ্রহে কোনো ত্রুটি রয়েছে তাহলে আমার মধ্যে খুঁত দেখার দোষ গড়ে উঠবে। ফলে আমার মধ্যে আর ভক্তির বিকাশ হবে না।"
তাই তিনি দূরে, গরুড় স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন এবং সেখান থেকে জগন্নাথদেবকে দেখতেন। দরজার পাথরের কাঠামোর উপর তিনি হাত রাখতেন এবং তাঁর পরম ব্যাকুলতা ও ভালবাসার উষ্ণতা এমন ছিল যে সেই দরজার কাঠামোর পাথর গলে গিয়েছিলো। আজও আপনারা পুরীতে গেলে গরুড় স্তম্ভের কাছে দরজার কাঠামোতে চৈতন্য মহাপ্রভুর আঙুলের ছাপ দেখতে পাবেন। 

জগন্নাথদেব অনেক ধরনের মানবীয় লীলা করেন। তার মধ্যে একটি অলৌকিক লীলা হলো জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা। রথযাত্রার প্রায় ১৬ দিন আগে, ভগবান জগন্নাথ, তাঁর ভাই বলরাম এবং তাঁর বোন সুভদ্রাকে একটি আনুষ্ঠানিক জল স্নান (১০৮ কলসি) করানো হয় - যা স্নানযাত্রা নামে পরিচিত। ঠান্ডা জলে স্নান করার ফলে ভগবান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৫ দিন একান্তে বিশ্রাম করেন। এই সময়কাল ‘অনাসর’ নামে পরিচিত। ১৫ দিন পর ভগবান ফিরে আসেন এবং ভক্তদের দর্শন দেন। এই ১৫ দিন দর্শন বন্ধ রাখার ফলে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথদেব এর দর্শন থেকে বঞ্চিত থাকতেন। মহাপ্রভু অনুভব করতেন যেন তিনি সব হারিয়েছেন। তিনি ১৮ কিলোমিটার দূরে আলারনাথ নামে একটি জায়গায় যেতেন এবং সেখানে একটি পাথরের উপর শুয়ে থাকতেন। তাঁর বিরহ বেদনার তাপে সেই পাথর গলে যেত। আপনারা যদি আলারনাথ যান, আজও সেই গলিত পাথর দেখতে পাবেন। 

অবশেষে যখন দরজা খোলা হতো এবং জগন্নাথকে মন্দিরের বাইরে আনা হতো, তখন মহাপ্রভু পরম ব্যাকুলতার সাথে সেখানে যেতেন জগন্নাথকে ‘কৃষ্ণ’-ভাবে রথের উপর দেখার জন্য। এই রথযাত্রাকে আরও মহিমান্বিত করে তোলার জন্য তাঁর ভক্তদের তিনি ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ করতেন। এক-একটি দলে আটজন করে মৃদঙ্গবাদক, একজন প্রধান গায়ক এবং কিছু অনুগামী থাকতেন। এইভাবে তিনি সব ব্যবস্থা করতেন। রথের সামনে তাঁরা সবাই নৃত্য করতেন এবং তাঁদের মধ্যমণি হয়ে মহাপ্রভু নৃত্য করতেন। কৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রাকে কুরুক্ষেত্র থেকে ব্রজে নিয়ে যাওয়ার সময় গোপীদের যে অনুভূতি ছিল – সেই একই অনুভূতি প্রকাশ পেত চৈতন্য মহাপ্রভুর মধ্যে রথযাত্রা চলাকালীন। জগন্নাথকে পুরীধাম থেকে গুন্ডিচা মন্দিরে (মাসির বাড়ি) নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর আন্তরিক ভাব এমন হত যেন শ্রীকৃষ্ণকে কুরুক্ষেত্র থেকে ব্রজে নিয়ে যাচ্ছেন। দিব্য অনুভূতির সাথে তিনি নিজেই যেন রাধা হয়ে কৃষ্ণকে বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। রথযাত্রায় চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর শিষ্যদের নিয়ে গভীর ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে রথের সামনে নৃত্য করতেন, ভগবানের নাম সংকীর্তন করতেন এবং তাঁর মহিমা গুণগান করতেন।

সুতরাং সেই লীলা, যা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রথযাত্রায় প্রণয়ন করেছিলেন, রথযাত্রাকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে। এখনো পর্যন্ত সারা বিশ্বের হাজার হাজার শহরে রথযাত্রা আয়োজিত হয়। শুধু জগন্নাথের নয়; রাধাকৃষ্ণ, সীতারাম সহ আরও অনেক বিগ্রহের রথযাত্রা পালন করা হয়।

এই যুগে রথযাত্রা উৎযাপন 

আজও বছরে একবার, ভগবান জগন্নাথদেব (শ্রীকৃষ্ণ), শ্রীবলদেব (বলরাম), এবং সুভদ্রাদেবীকে পৃথক পৃথক রথে উপবেশন করানো হয় এবং ভক্তরা তাঁদের টেনে নিয়ে যায় গুন্ডিচা মন্দিরে। এখনো অবধি ভগবান জগন্নাথের হাজার হাজার ভক্ত প্রতি বছর রথযাত্রা উপলক্ষে পুরীর গুন্ডিচা মন্দিরের উদ্দেশ্যে রথ টেনে সেই পরম্পরা পালন করে চলেছেন।